অত্যাচারের সময় মুখ বেঁধে রাখা হত বন্দিদের। পর্যাপ্ত খাবার, জল, ওষুধ— কিছুই জুটত না। কখনও কখনও এক বন্দিকে দিয়ে আর এক বন্দিকে ধর্ষণ করানো হত। কী চলত সৈদনায়ার চার দেওয়ালের আড়ালে? বলছি সিরিয়ার কুখ্যাত কারাগার সেদনায়ার কথা।
আসাদ সরকারের পতনের পরেই খুলে দেওয়া হয়েছে সেদনায়ার ফটক। ছাড়া পেয়েছেন বছরের পর বছর ধরে বন্দি হয়ে থাকা কয়েদিরা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে একের পর এক গুম-খুন এবং অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সিরিয়ার এই কারাগারে। ইংল্যান্ডের সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইট্সর ২০২১ সালের একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, সিরিয়ার জেলগুলিতে এক লক্ষেরও বেশি বন্দির মৃত্যুদণ্ড কিংবা হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৩০,০০০-রও বেশি বন্দি সেদনায়ায়।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন থেকেই জানা গেছে, সেদনায়ার চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে দু’টি পৃথক জেল। একটি লাল এবং একটি সাদা রঙের ভবন। লাল রঙের ভবনে রাখা হত সাধারণ নাগরিকদের। আর সাদা রঙের ভবনে থাকতেন সামরিক ও রাজনৈতিক বন্দিরা। আল-কাবুনের মিলিটারি ফিল্ড কোর্টে নামমাত্র বিচারের পর ফাঁসির সাজা শোনানো হত লাল ভবনের বন্দিদের।
‘বিচারপ্রক্রিয়া’ শেষ হয়ে যেত মাত্র এক থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই। যে দিন এক এক জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হত, সেই দিনটিকে ‘পার্টি’ বলে অভিহিত করতেন কারারক্ষীরা। কখনও কখনও আবার ‘গণফাঁসি’-রও আয়োজন করা হত। তালিকায় নাম থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের এক এক করে নিয়ে আসা হত লাল ভবনের বেসমেন্টের একটি গোপন কক্ষে। সেখানে দু’তিন ঘণ্টা ধরে চলত অকথ্য অত্যাচার, মারধর। তার পর গভীর রাতে চোখ বেঁধে বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হত সাদা ভবনের একটি নির্দিষ্ট কক্ষে। সেখানেই একসঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হত তাদের।
প্রতি সপ্তাহে এক কিংবা দু’বার এই ‘পার্টি’ হত। প্রতি ‘পার্টি’-র রাতে ফাঁসি হত ২০ থেকে ৫০ জন কয়েদির। তবে এই ‘পার্টি’-র বিষয়ে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতেন না বন্দিদের কেউ। ফাঁসির মাত্র মিনিটখানেক আগে তাঁদের জানানো হত, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাদের!
এমনকি, লাল ভবনের কারারক্ষীরাও জানতে পারতেন না, গভীর রাতে সাদা ভবনে নিয়ে যাওয়ার পর বন্দিদের সঙ্গে কী হয়। ফাঁসির পর মৃতদেহগুলি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হত তিশরিন হাসপাতালে। সেখানে নামপরিচয় নথিভুক্তকরণের পর গণকবর দেওয়া হত দেহগুলিকে। অ্যামনেস্টির দাবি, ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার বন্দিকে বিনা বিচারে এ ভাবেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেদনায়ায়।
সৈদনায়ায় বন্দিদের উপর অত্যাচারের ইতিহাসও কম নয়। বন্দিদের নির্বিচারে মারধরের পাশাপাশি চলত যৌন নির্যাতনও। কখনও কখনও এক বন্দিকে দিয়ে আর এক বন্দিকে ধর্ষণ করানো হত। এর পাশাপাশি, পর্যাপ্ত খাবার, জল, ওষুধ— কিছুই জুটত না। অত্যাচারের সময় মুখ বেঁধে রাখা হত বন্দিদের। অকথ্য অত্যাচারের ফলে কোনও কোনও বন্দি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেন।
রবিবার (৮ ডিসেম্বর) সৈদনায়া থেকে মুক্তি পাওয়া এক বন্দির ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে দেখা যায়,সেদনায়ার বাইরে রাস্তার ধারে গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে রয়েছেন শীর্ণ এক যুবক। কথাবার্তা অসংলগ্ন। অত্যাচারের চোটে ভুলেছেন নাম-ঠিকানাও। ভিডিয়োটি প্রকাশ্যে আসার পরেই ফের এক দফা চর্চা শুরু হয়েছে কুখ্যাত এই জেল নিয়ে।
সেদনায়ার ফটক খুলতেই উচ্ছ্বাস শুরু হয়ে গেছে সে দেশে। তবে সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইট্স-এর প্রতিষ্ঠাতা ফাদেল আবদুলঘানি জানান, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি নিয়ে এ উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। কিন্তু পাশাপাশি সব ধরনের বন্দিরা মুক্তি পেলে তা দুশ্চিন্তারও কারণ বইকি!
উল্লেখ্য, সিরিয়ার বিদ্রোহী সশস্ত্র দুই গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’(এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’র যৌথবাহিনীর আগ্রাসনে পিছু হটেছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকার। দেশ ছেড়েছেন আসাদ। দামাস্কাসকে ‘স্বাধীন’ বলে ঘোষণা করেছে সে দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠী। কাতারের দোহায় সিরিয়ার দূতাবাসে শুরু হয়েছে ‘স্বাধীনতা’ উদ্যাপন।
প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ গাজ়ি জালালিও জানিয়েছেন, তিনি ক্ষমতার হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত। তবে তা হোক শান্তিপূর্ণ।