সিলেটে শিশুদের আলোর পথ দেখাচ্ছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো‌’র সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি

মো. সাইফুজ্জামান রানা

মহান সাধক হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরাণ (র.)সহ ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি বাংলাদেশের স্বাধিকার এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে। মুঘলদের সাথে যুদ্ধ, নানকার বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন এবং সর্বোপরি মুক্তিযদ্ধে এ জেলার অবদান অনেক। সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, পিয়াইল নদী এবং সিংগুয়া, চাতলার বিলসহ ছোট বড় সব মিলিয়ে ৮২ টি হাওর এলাকা নিয়ে সিলেট জেলা। এর আয়োতন ৩৪৫২.০৭ বর্গ কিলোমিটার। জাতীয় আদম শুমারি ২০১১ অনুযায়ি এর জন সংখ্যা ৩৫,৬৭,১৩৮ জন। নারী-পুরুষের হার প্রায় সমান। সিলেটে মানেই চা এবং কমলার দেশ। তাছাড়া জাফলং, বিছানাকান্দিসহ আরো বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্রতো আছেই। এই জেলায় জনঘনত্বের পরিমাণ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯৯৫ জন। অর্থনৈতিক ভাবে বেশ সমৃদ্ধ হলেও শিক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে অপরাপর জেলার তুলনায়। সারাদেশের হিসাবেতো বটেই শিক্ষায় বেশ খানিকটা পিছিয়ে সিলেট এ কথা বলায় যায়। কেননা সরকারি হিসাব মতে দেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭৩.৯ শতাংশ সেখানে সিলেটে এই হার ৫১.২ শতাংশ (সিলেট জেলার সরকারি ওয়েব পোর্টাল এর তথ্য অনুযায়ি)। তবে এটা পরিষ্কার যে, দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় সিলেটে নিরক্ষর লোকের সংখ্যা একটু বেশি।

স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত করার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি নানা উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এখনো বাস্তবায়িত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন পরিকল্পনা ৪ এর অধীনে দেশের ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী ঝরে পড়া এবং বিদ্যালয় বহির্ভূত নিরক্ষর শিশুদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে “সেকেন্ড চান্স এডুকেশন” নামে একটি কর্মসুচর মাধ্যমে ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) শিশু নিয়ে একটি পাইলট কার্যক্রম উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ধারাই পরিচালনা করছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো গত ২০১৭ সাল থেকে। বর্তমানে আরো ৯,০০,০০০ (নয় লক্ষ) শিশুর জন্য কার্যক্রম শুরুর প্রস্ততিমূল কার্যক্রম শেষ হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই মাঠ পর্যায়ে এটি শুর হবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, গ্রাম বা মহল্লা পর্যায়ে এই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও। সেকেন্ড চান্স এডুকেশন পাইলট কর্মসূচিটি দেশের যে ৬ টি জেলার গ্রাম এবং শহরে বাস্তবায়িত হচ্ছে সিলেট তার মধ্যে একটি। সিলেটে দুটি এনজিও (আরডিআরএস এবং জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন) মাঠ পর্যায়ে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করছে। সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কিভাবে সম্ভাবনাময়ী কিন্তু নিরক্ষর ও ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি জীবন মানে কিভাবে ভূমিকা রাখছে তা দেখতেই এই প্রতিবেদক গত জানুয়ারির শেষ দিকে হাজির হয়েছিল সিলেটে। এই জেলায় মোট উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৪১ টি এবং এ সব বিদ্যালয়ের মাধ্যরম ১৯,৩৮২ জন শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে আরডিআরএস এর ৪০৮ টি বিদ্যালয়ে ৯৩৯৪ জন এবং জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন ৩৩৩ টি বিদ্যালয়ে ৯৯৮৮ জন শিশুকে উপানুষ্ঠানিক ধারায় প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে সিলেটের যে কয়টি উপজেলায় সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচির পাইলট কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে দক্ষিণসুরমা তার মধ্যে একটি। এই উপজেলায় মোট ৮৩ টি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর পরিবারের ৮ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করছে। গত ৩০ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে সকালে আমরা সিলেট উপশহর থেকে হাজির হয়েছিলাম দক্ষিণসুরমা উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামের কেন্দ্রটিতে। সিলেট শহর থেকে দাউদপুরে এই কেন্দ্রটির দূরত্ব ১৫/১৬ কিলোমিটার হবে। সকাল সোয়া ১০ টার দিকে আমরা উপস্থিত হই। সেই সময়ে শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিলো ২০ জন। এদের মধ্যে ছেলে ৭ জন আর ১৩ জন মেয়ে। অবশ্য এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩২ জন। সেই তুলনায় উপস্থিতি একটু কম। কেন উপস্থিতি কম তার ব্যাখ্যা দিলেন শিক্ষক আবিদা জান্নাত। তার কথায়- এটি একটি অ্যাবিলিটি বেইজ এক্সিলারেটেড লার্নিং (এবিএএল) ব্যবস্থা। ফলে এই কেন্দ্রটি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত (মধ্যাহৃ বিরতি ছাড়া) শিশুদের জন্য খোলা থাকে। শিশুরা সকালে না আসতে পারলে বিকেলের শিফটে আসে। যারা সকালে আসতে পারেনি তারা বিকেলের শিফটে আসবে। সকালে কোন কোন শিশু আর বিকেলে কোন কোন শিশু আসবে তা চিহিৃত করা থাকলেও যে কেউ যে কোনো শিফটে আসতে পারে। অনেক শিশু আবার দু-বেলায় আসে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ধারার এবিএএল মডেল এর বৈশিষ্ট এটি। এই ব্যবস্থায় শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষক শিশুর চাহিদা ও যোগ্যতা অনুযায়ি একাধিক শ্রেণির পাঠ পরিচালনা করে থাকেন। অর্থাৎ উপস্থিত শিক্ষার্থীর যোগ্যতা অনুযায়ি কেউ পড়ছেন প্রথম শ্রেণির, কেউবা দ্বিতীয় আবার কেউ তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণির পাঠ। একটি শ্রেণিকক্ষে একাধিক শ্রেণির শিশুর পাঠ পরিচালনা ব্যবস্থার নাম এবিএএল মডেল।

সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল থেকে এই শিক্ষা কেন্দ্রটি শুরু হয়েছে। ছায়া ঘেরা সুন্দর মনোরম পরিবেশে এটির অবস্থান। আধাপাকা ঘর। মেঝে এবং দেয়াল পাকা কিন্তু ছাউনি টিনের। আয়তনে যথেষ্ট বড় না; তবে খুব ছোট সেটাও বলা যাবে না। শিক্ষক আবিদা জান্নাত শুরু থেকেই শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। পাঠ পরিচালনায় তার যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। আমরা যখন বিদ্যালয়ে পৌঁছালাম তখন সবুজ দল তথা দ্বিতীয় শ্রেণি এবং হলুদ তথা তৃতীয় শ্রেণির গণিক ক্লাস চলছিলো। শিক্ষক তার পাঠ পরিচালনায় আলোচনার পাশাপাশি দলীয় কাজ, প্রশ্ন-উত্তর পদ্ধতির সমন্বয়ে পাঠ পরিচালনা করলেন। শেষে মৌখিক মূল্যায়ন ও পরে বাড়ির কাজ দিয়ে গণিত বিষয়ের পাঠ শেষ করেন। শিশুদের পাঠ পরিচালনার ফাকে ফাকে আলাাপ হলো শিক্ষক আবিদা জান্নাতের সাথে। কথায় কথায় জানা গেলো তিনি স্নাতক পাস। শিক্ষক হিসেবে ৪ দিনের প্রশিক্ষন পেয়েছেন জেসিএফ থেকে। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানান আগে অনেকেই বর্ণ চিনতো না, কেউ কেউ চিনলেও নিজে পড়তে পারতো না। এখন তারা বানান করে বাংলা পড়তে পারে। শিক্ষক হিসেবে এটা আমাকে খুব আনন্দ দেয়। শিক্ষকের কথার সূত্র ধরে শিপুল আহম্মেদ নামের এক শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। শিপুল ১২/১৩ বছরের কিশোর। বাবা রিয়াজ উদ্দিন। কৃষি শ্রমিক। মা সুমা বেগমও কৃষিকাজ করেন। মূলত এই পরিবারটি বর্গা জমির চাষ করেন। অন্যদিকে শিপুল এই বিদ্যালয়ে তথা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। এবং স্থানীয় দাউদপুর বাজারে একটি মুদি দোকানে কাজ করে প্রতিদিন ১০০ টাকা হাজিরায়। সকাল ১১ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ পর্যন্ত কাজ আর সকালের শিফটে উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। শিপুল নিজেই বলে “আগে আমি পড়তে পারতাম না কিন্তু এখন বানান করে পড়তে পারি। আগে যেখানে দোকানে কেউ কিছু চাইলে অনুমান করে সেটা বের করে দিতাম কিন্তু এখন আমি প্যাকেট দেখে পড়ে দিতে পারি। আমার খুব ভালো লাগে। কেউ কিছু নিয়ে গেলে আমি সেটা লিখেও রাখি। মালিক এলে সেটা দিই। এখানে এই স্কুল ছিলো বলে আজ আমি পড়তে পারছি । না থাকলে নিরক্ষর থাকতে হতো আমাকে। আমি নিজেই একটা দোকান করার কথা ভাবি। কারণ আমি এখন পড়তে পারি।”
শিক্ষক আবিদা আপার কথার সূত্র ধরে আলাপ হয় আরো কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে। এদের মধ্যে সাদিয়া আক্তার একজন। আগে স্কুলে আসতো না। এখন নিয়মিত এই স্কুলে আসে। সে এখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। নিজে বানান করে বাংলা পড়তে পারে। ইংরেজিও পড়তে পারে অল্প অল্প। সাদিয়ায় জানালো তার স্কুলে পড়ার গল্প। “বাড়িতে অভাব এবং বাবা-মায়ের অজ্ঞতার কারণে ছোট বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়া হয়নি আমার। সমবয়সী মেয়েরা কাধেঁ ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যেত আর আমার খুব ইচ্ছে করতো ওদের মতো স্কুলে যেতে। কিন্তু আমিতো পড়তে পারি না। আমাকেতো কেউ স্কুলে ভর্তি করবে না। সকলে যখন স্কুলে পড়ে তখন আমি বাড়িতে মায়ের সাথে বাশের ঝুড়ি তৈরি করি। আমার মা এবং আমিই ঝুড়ি তৈরি করি। এগুলো বাড়ি থেকেই ব্যাপরীরা নিয়ে যায়। প্রতিদিন আমি যে ঝুড়ি তৈরি করি সেগুলো বিক্রি করে ৭০/৮০ টাকা আয় হতো আমার। সেটা মা-বাবা সংসার চালাতে খরচ করতেন। কিন্তু গ্রামে এই স্কুল হলে অনেকের সাথে আমিও স্কুলে ভর্তি হই। নিয়মিত স্কুলে আসি। পড়তে শিখেছি। আমি কিন্তু স্কুল থেকে ফিরে গিয়ে আমার ঝুড়ি তৈরির কাজ মায়ের সাথে এখনও করি। এখনো আমি প্রতিদিন ৫০/৬০ টাকার ঝুড়ি তৈরি করি। সেই টাকা আমাদের পরিবারে কাজে লাগে। আমার ইচ্ছে আছে এখান থেকে প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে ভর্তি হবো। দাউদপুরের এই উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুধু আবিদা নয় আরো কয়েকজন শিশু রয়েছে যারা সকালে স্কুলে আসে আর বিকেলে মায়ের সাথে ঝুড়ি তৈরি করে পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করছে। এমিবা আক্তার (চতুর্থ শ্রেণি), রহিমা আক্তার (তৃতীয় শ্রেণি), ফারজানা আক্তার (চতুর্থ শ্রেণি) এরা প্রত্যেকেই প্রাথমিকের পাঠ শেষে করে মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হচে চাই।

শুধু শিপুল, সাদিয়া, এমিবা, রহিমা, ফারজানা নয় বিদ্যালয়ে উপস্থিত অপরাপর সকল শিশুর চোখে স্বপ্ন আর মনে আত্মবিশ্বাসের সোনালী বীজ বুনে দিয়েছে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি। এ সব শিশু একদিন লেখা-পড়া শিখে মাথা উচু করে সম্মানের সাথে পরিবার ও দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে এই ভিত ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে সেটা বুঝতে বাকি থাকে না আমাদের। আমাদেরর কথা ফুরিয়ে আসে। ফেরার পথ ধরি আমরা। আমাদের দ্বিচক্রযানটি ছুটতে থাকে শহরের দিকে শীতের পড়ন্ত দুপুরের উষ্ণতা শরীরে মাখতে মাখতে। কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে এই সব শিশুদের মুখ আর তাদের স্বপ্নগুলো। সত্যিইতো সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি ঝরে পড়া ও বিদ্যালয় বহির্ভূত নিরক্ষর শিশুদের জীবেন নতুন আলো নিয়ে এসেছে তা অস্বীকার করি কেমন করে।

লেখক: শিক্ষা বিষয়ক উন্নয়ন কর্মী এবং বর্তমানে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচিতে ডেপুটি ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত।

Comments (0)
Add Comment