‘বানিয়াসে আমার বন্ধুর বাগ্দত্তাকে গুলি করা হয়েছে। তারা (হামলাকারীরা) কাউকে তাঁকে সহায়তা করতে দেয়নি। ফলে রক্তক্ষরণ হয়ে তিনি মারা যান। তাঁকে এখনো কবর দেওয়া যায়নি।’ সিরিয়ার লাতাকিয়া শহরের তারতুসের কাছাকাছি এলাকায় চলমান হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
অস্ত্রধারীরা ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষ হত্যা করছে জানিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘বুস্তান আল-বাশা গ্রামে আমার চাচি থাকেন। তাঁর সব প্রতিবেশীকে হত্যা করা হয়েছে।’
নিজেদের সিরিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠী হায়াত আল-শামের (এইচটিএস) যোদ্ধা দাবি করা এসব অস্ত্রধারী ওই প্রত্যক্ষদর্শীর বাসায়ও তল্লাশি করেন। তাঁদের মহল্লা থেকে সাকল্যে ২০টি গাড়ি নিয়ে যান।
এই নারী প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, অস্ত্রধারীরা নিজেদের এইচটিএসের যোদ্ধা দাবি করলেও তা সত্যি নয়। তারা ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ সদস্য। তিনি বলেন, যে ব্যক্তিই পালাতে চেষ্টা করেছেন বা যাঁকে সন্দেহজনক মনে করছে, তাঁকেই তারা হত্যা করছে।
কিছু সাধারণ নাগরিক লাতাকিয়ায় অবস্থিত রাশিয়া পরিচালিত হমেইমিম বিমানঘাঁটিতে পালিয়ে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন। কিন্তু বিমানঘাঁটিতে যাওয়ার পথে তল্লাশিচৌকিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর লোকজন অবস্থান করছিলেন। এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘তল্লাশিচৌকিতে তাঁদের কাছে প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাঁরা আলাউইত সম্প্রদায়ের কি না।’
গত বৃহস্পতিবার সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় শহর লাতাকিয়া ও তারতুসে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত যোদ্ধারা সমন্বিতভাবে হামলা শুরু করে। বর্তমান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর গুপ্ত হামলা চালানো হয়।
সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দ্রুত পাল্টা হামলা শুরু করে। সঙ্গে নতুন সরকারের প্রতি অনুগত বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদেরও এই অভিযানে যুক্ত করা হয়।
গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলের দিকে হাজার হাজার সরকারি বাহিনীর সদস্য পাঠানো হয়েছে। বাশারপন্থীদের দমনে তাঁরা হেলিকপ্টার গানশিপ, ড্রোন ও কামান ব্যবহার করছেন। একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, নিরাপত্তা বাহিনীর পাল্টা হামলা ‘প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডে’ রূপ নিয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের (এসওএইচআর) তথ্যমতে, শুক্রবার পর্যন্ত দুই দিনে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
এসওএইচআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাতাকিয়া ও তারতুসে তিন দিনে আলাউইত সম্প্রদায়ের অন্তত ৭৪৫ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সেখানে বাশারপন্থী ১৪৮ যোদ্ধাকেও হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সিরিয়ার নতুন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন প্রায় ১২৫ জন।
বাশারপন্থী যোদ্ধারা আলাউইত সম্প্রদায়ের সদস্য। এটি শিয়া ধর্মাবলম্বীদের একটি শাখা। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলেই এই সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ বাস করেন। বাশার আল-আসাদের পরিবারও এই সম্প্রদায়ের। কিন্তু এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশের সঙ্গে বাশার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর বাশার সরকারের পতনের পর থেকে এই সম্প্রদায়ের মানুষকে হামলার লক্ষ্য বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংঘাত এখনো পুরোপুরি থামেনি। রোববার সংঘাত চতুর্থ দিনে প্রবেশ করেছে। এদিন রাজধানী দামেস্কের মাজ্জাহ পাড়ায় একটি মসজিদে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আহমেদ আল-শারা সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতীয় ঐক্য ও দেশের শান্তি রক্ষা করতে হবে। আমরা মিলেমিশে বাস করতে পারি। সিরিয়ায় বর্তমানে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলো যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে বলে আগে ধারণা করা, হয়েছিল তারই অংশ।’ সাধারণ মানুষকে যারা নিশানা করছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আল-শারা।
সংঘাতের সময় লাতাকিয়ায় ছিলেন, এমন একজন নারীও মিডল ইস্ট আইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। বর্তমানে তিনি জার্মানিতে বসবাস করেন। তাঁর পরিবার থাকে তারতুস শহরের বানিয়াসে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি তাঁদের [পরিবারের সদস্যদের] প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন তাঁরা পারমায়ার দিকে চলে গেছেন। সেখানে তাঁরা মাঠে মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন।’
‘তারা (অস্ত্রধারীরা) আমার খালার এক বান্ধাবীকে তাঁর বাসায় হত্যা করেছে। ওই মেয়ের নাম জিনা। তারা আমাদের দুটি বাসা পুড়িয়ে দিয়েছে। আল্লাহর রহমতে উভয় বাসার মানুষজন লুকিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন।’
অস্ত্রধারীরা বানিয়েতে ফারশ কাবিহ গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। কিছু সুনির্দিষ্ট ঘরের সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে হত্যা করা হয়েছে। একটি বাড়িতে এক পরিবারের কয়েক প্রজন্মের সদস্যরা জড়ো হয়েছিলেন। গত শুক্রবার সেখানে অস্ত্রধারীরা হানা দেয়।
ওই পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, অস্ত্রধারীরা এক নারীর পায়ে গুলি করে, তাঁর ভাই ও স্বামীকেও গুলি করে। আজ পর্যন্ত তাঁদের কবর দেওয়া যায়নি।
সিরিয়ায় চলমান এই সংঘাতের নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব। দেশটি সিরিয়ার সংঘাতকে ‘বেআইনি গোষ্ঠী’ কর্তৃক সংগঠিত ‘অপরাধ’ বলে বর্ণনা করেছে। পাশাপাশি নতুন সরকারের প্রতি নিজেদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে।
সিরিয়াবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত গেইর পেডারসেন সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘সব পক্ষকে কালবিলম্ব না করে সংযম দেখানো এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষার প্রতি পূর্ণ সম্মান দেখানো জরুরি হয়ে পড়েছে।’
রবিবার (৮ মার্চ) সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সরকারি সংবাদ সংস্থা সানাকে জানান, তারতুসের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেতানিতা গ্রামে লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
অন্যান্য স্থানেও নাশকতামূলক ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। দারা ও দামেস্ক শহরকে সংযুক্তকারী একটি বৈদ্যুতিক সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দারা ও সেওয়াইদার টেলিফোন যোগাযোগব্যবস্থা ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আঘাত করে পালিয়ে যাওয়া (হিট অ্যান্ড রান) কৌশলের অংশ হিসেবে বাশারপন্থীরা এসব করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগেও তারা সরকারি সম্পত্তিতে এই ধরনের হামলা চালিয়েছে।
অনেকগুলো পানির পাম্প স্টেশন ও জ্বালানি ডিপোতেও হামলা চালানো হয়েছে। সানার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সাবেক সরকারের অবশিষ্টদের’ হামলার পর বানিয়াস গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষ হয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় অনেকগুলো ধর্মীয় গোষ্ঠী রয়েছে। দেশটির নাগরিক সমাজও বেশ বড় ও বৈচিত্র্যময়। কিন্তু নতুন অন্তর্বর্তী সরকারে এসব ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং নাগরিক সমাজের সব পক্ষকে স্থান দেওয়া হয়নি। তাই তা যথেষ্ট অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় বর্তমান সরকার নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশটিতে ‘ট্রানজিশনাল’ সরকার ঘোষণা করা হবে। এই সরকার কতটা বহুত্ববাদী হয় হয়, সেটা সিরিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।