একটি চরিত্র, যে সরাসরি কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়, তবে তার প্রেমিকাকে থাপ্পড় মারার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝড় ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায়। হায়দরাবাদে এক পশু চিকিৎসকের গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় গর্জে ওঠা নারী-পুরুষের একাংশ মনে করে, এই ধরনের ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির’ প্রদর্শনই মেয়েদের উপরে যৌন অপরাধের পথ প্রশস্ত করে।
যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির দাপটের মাঝে একটা কথা সকলেই মানবেন, সিনেমা-সিরিজ়ের প্রভাব সাধারণ দর্শকের উপরে অপরিসীম। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত নাবালক ও যুব সমাজের উপরে হয়তো খানিক বেশি। কারণ বাস্তব ও কল্পনার মাঝের সূক্ষ্ম ফারাক বোঝার মতো পরিণতি হওয়ার আগেই তারা নানাবিধ অ্যাডাল্ট কনটেন্ট দেখে ফেলে। অপরিণত মনে সিনেমা-সিরিজ়ে দেখানো অপরাধ কতটা প্রভাব ফেলে? উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা নাবালক অপরাধীর সংখ্যা এমন প্রশ্ন ভাবতে বাধ্য করছে।
ধর্ষণ, খুন, মেয়েদের উপরে যৌন অত্যাচারের মতো ঘটনা বারবার ছবির পর্দায় উঠে এসেছে। কখনও রূঢ় বাস্তব, কখনও বা বাস্তবের অতিরঞ্জন। সিনেমার স্টাইলে বাস্তবে খুনের ঘটনাও সংবাদপত্রে স্থান পেয়েছে। তা বলে সিনেমা-সিরিজ়ে অপরাধ দেখানো হবে না, সেটা তো হতে পারে না। পরিচালক অরিন্দম শীলের মতে, ‘‘সিনেমার পজ়িটিভ প্রভাব তার নেগেটিভিটির চেয়ে অনেক বেশি। যদি কেউ সিনেমাকে বাস্তব ভেবে অপরাধে প্রবৃত্ত হয়, তার মানে তার মানসিকতায় সমস্যা রয়েছে। তার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন। সুস্থ যৌনশিক্ষার প্রয়োজন। সিনেমাকে সেই দোষে দায়ী করা যায় না।’’
‘ভিঞ্চিদা’ ছবিতে এক নাবালকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ঋদ্ধি সেন, যে নিজের মদ্যপ বাবাকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে খুন করে। এমন চরিত্রের প্রভাব কি অপরাধপ্রবণতা বাড়ায়? ‘‘একটি চরিত্রের পরিণতি ছবিতে কী ভাবে দেখানো হচ্ছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে অপরাধ করছে, তাকে মহিমান্বিত করে দেখানো হচ্ছে কি না, সেটার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। তবে ছবিতে অনর্থক আইটেম ডান্স, মহিলাদের পণ্য হিসেবে দেখানো সাধারণ দর্শকের উপরে খারাপ প্রভাব বিস্তার করে। সেটা পরোক্ষ ভাবে তাদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ানোর জন্য দায়ী হলেও হতে পারে। অনেক ওয়েব পোর্টালেও যথেচ্ছ ভাবে যৌন কনটেন্ট দেখানো হয়। সেটাও সুস্থ প্রভাব ফেলে না,’’ মত ঋদ্ধির।
মেয়েদের উপরে সরাসরি অপরাধের প্রদর্শন এই আলোচনার একটা দিক। আর অন্য দিকটি হল, কবীর সিংয়ের মতো চরিত্রের জোরালো উপস্থিতি। এই ছবির পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি ভঙ্গা ছবিতে কবীরের চড় মারার সপক্ষে যুক্তিও দিয়েছিলেন। প্রিয়ঙ্কা রেড্ডির জন্য বিচার চেয়ে তাঁর টুইট, ‘‘এই ধরনের অপরাধ নির্মূলের জন্য প্রয়োজন ভয়ের উদ্রেক করা। অপরাধীদের কঠোর শাস্তিই সেই ভয়ের শাসনকে প্রতিষ্ঠা করবে…’’
তাঁর টুইটের জবাবে পরিচালক বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে পোস্ট করেন, ‘‘সেই ভয়ের কারণে কি তারা থাপ্পড় মারা থেকে বিরত হবে?’’ দিন কয়েক আগে এক আলোচনায় দক্ষিণী অভিনেত্রী পার্বতী ‘জোকার’-এর মুখ্য চরিত্র ও ‘কবীর সিং’-এর তুলনা করে বুঝিয়েছিলেন, কেন কবীর সিংয়ের মতো চরিত্র নিয়ে তাঁর আপত্তি রয়েছে। সরব হয়েছিলেন নন্দিতা দাশও। সমস্যা হচ্ছে, সিনেমায় অনেক সময়েই পুরুষের আপত্তিকর আচরণকে ‘স্বাভাবিক’ করে দেখানো হয়। দীর্ঘ দিন ধরে হিন্দি ছবির গানে নায়িকার পিছু করাকে রোম্যান্টিক ভাবে দেখানো হয়েছে। গ্যাংস্টার মুভিতেও মেয়েদের সম্ভোগের পণ্য হিসেবে দেখানোর প্রবণতা থাকে।
সমাজে যা ঘটছে, এক অর্থে তার প্রতিফলন ঘটে পর্দায়। মোবাইলের দৌলতে সেই কনটেন্ট উপযুক্ত বয়সে পৌঁছনোর আগেই অনেকে আত্মসাৎ করে। যদি কখনও যৌনতা বা অপরাধপ্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তা আলোচনা করার মতো পরিসর তাদের থাকে না। পরিচালক এবং রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘সমাজ বদলাচ্ছে। ভ্যালু সিস্টেম পাল্টাচ্ছে। এ অবস্থায় অভিভাবকত্বের অভাবে যাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা রয়েছে, তাদের উপরে এ ধরনের ছবি প্রভাব বিস্তার করছে।’’
নানাবিধ প্রভাবের মাঝে বাস্তবকে দায়িত্বপূর্ণ ভাবে পর্দায় তুলে ধরা এখনকার শিল্পী ও পরিচালকের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।