পারস্পরিক যোগাযোগ, তথ্য আদান-প্রদান এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খবরাখবর জানার জন্য চিঠি, সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের ওপর নির্ভরতা বহুকাল থেকে চলে আসছিল। পরিবারের একে অন্যের খোঁজখবর চিঠির মাধ্যমে আমরা জানতে পারতাম। এই মাধ্যমে আমাদের ভাবের আদান-প্রদান হতো। মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ছিল চিঠি।
দৈনিক পত্রিকা কিংবা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে আমরা কবিতা, গল্প লিখতাম। অনেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত কখন তার লেখাটি প্রকাশিত হবে। পাঠকরাও অপেক্ষা করত পছন্দের লেখকের লেখা পড়ার জন্য। একটি চিঠি পাওয়ার জন্য আমাদের কতই না অপেক্ষা।
চিঠির ভাষা, লয়, মাধুর্য আমাদের মুগ্ধ ও উদ্বেলিত করত। আমরা আকুল হয়ে অপেক্ষা করতাম কখন প্রিয়জনের চিঠি আসবে। ডাকপিয়নের কাছেও চিঠির বিষয়ে খরব নিতাম। তেমনিভাবে সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডিও চালু করতাম দেশ ও দেশের বাইরের খবরাখবর জানার জন্য।
বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত টেলিভিশনের সামনে থাকতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখার জন্য। নাটক, সিনেমা, গানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান পরিবারের সবার সাথে একসঙ্গে বসে উপভোগ করতাম। এতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হতো। সকালবেলা পত্রিকা না পড়লে যেন সারা দিন ভালো কাটত না। কালের বিবর্তনে যোগাযোগের সনাতন কোনো মাধ্যমের প্রতি আমাদের আজ মুখ ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে।
আমরা এখন আর চিঠি লিখি না বললেই চলে। রেডিও আমরা কজনই বা শুনি। সংবাদপত্র আমাদের সামনে টিকে আছে। অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে আমরা যখন যাবতীয় সংবাদ পাই, তখন কাগজে প্রকাশিত পত্রিকার প্রতি আমাদের আকর্ষণও আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আজ ক্লাসে খাতা-কলম নিয়ে আসতে চায় না। মোবাইলে লিখে কিংবা ক্লাস লেকচার রেকর্ড করে পড়াশোনায় অভ্যস্ত হতে যাচ্ছে। প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা আমাদের হাতে লেখার অভ্যাসকে একেবারেই কমিয়ে দিচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহারআধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের তথ্যের আদান-প্রদানকে সহজ করছে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মুহূর্তের মধ্যে আমরা যে কারো সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যাবতীয় কাজ সম্পাদন জীবনকে করছে সহজ ও সাবলীল। আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করছে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি। প্রযুক্তির সঠিক ও যুগসই ব্যবহার আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অযাচিত ব্যবহার ও বিকৃতি আমাদের অনেক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যোগাযোগের মাধ্যমগুলো যখন একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরিচালিত না হয়, তখন এর অপব্যবহার রূপান্তরিত হয়। রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মতো মাধ্যমকে রাষ্ট্র এবং এর কর্ণধাররা ইচ্ছা করলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কিন্তু ফেসবুক, ইউটিউব, আইপি টিভি ও অন্য মাধ্যমগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। মোটাদাগে বললে এখন যোগাযোগ মাধ্যম, যাকে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলি, তা একেবারেই উন্মুক্ত। আমরা যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে সময় পার করি। মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য আমরা ফেসবুক ব্যবহার করি। নিজে নিজে ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে ছড়িয়ে দিই। যা ভালো লাগে তাই আমরা করতে পারি। আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি আমাদের রবীন্দ্র, নজরুল কিংবা শরত্চন্দ্রের গল্প ও উপন্যাস পড়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। গান শোনা থেকে আমাদের বাদ দিয়েছে। ফলে একটি সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল প্রজন্ম গড়ে উঠছে না। নতুন প্রজন্ম একটি ভোগবাদী প্রজন্মের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে নিজেদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার উপযোগী করে তৈরি করাই বড় বিষয়। একটি উদার ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হয়ে আমরা নিজেদের গড়ে তুলছি না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি বড় দিক বিকৃতি। বিকৃত তথ্য উপস্থাপন, অন্যের মতামতে অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং কারণে-অকারণে নাক গলানো আমাদের দারুণভাবে পেয়ে বসছে। তথ্য ও ছবি বিকৃতি এবং বিকৃত ভিডিও প্রকাশ আমাদের কারো কারো ক্ষেত্রে মানসম্মানের হানি হয়ে দেখা দিচ্ছে। যোগাযোগ মাধ্যম এখন অনেকটা হাতের মুঠোয় এবং নাগালের মধ্যে। মুহূর্তের মধ্যে কোনো একটি খবর ভাইরাল হয়ে যায়। অনেক খবরে সত্যের লেশমাত্র থাকে না; কিন্তু ভাইরাল হয়ে যাওয়ার কারণে কারো কারো ক্ষতির কারণ হয়। আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব অনেক বেশি। তাদের সামনে যখন কোনো বিকৃত তথ্য ও ছবি প্রকাশ পায়, তখন তারা বিভ্রান্ত হয় এবং ভুল পথে চলতে বাধ্য হয়। ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার একজন শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষণীয় দিককে উপক্ষো করে ফেসবুকে চ্যাটিং ও ইউটিউবে ভিডিও দেখতে বেশি ব্যস্ত থাকে। ফলে তথ্য-প্রযুক্তির পরিপূর্ণ ব্যবহার থেকে তারা দূরে থাকছে।
এখনকার সময়ে বড়-ছোট সবাই আমরা সময় অতিবাহিত করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। নিজেদের ছবি এবং অন্যদের সঙ্গে নিজেদের ছবি দিয়ে আমরা বড়ত্বকে প্রমাণ করতে চাই। কারো মতামতের ওপর নিজের মতামত লিখে নিজেকে প্রকাশ করতে চাই কিংবা তাকে হেয় করতে চাই। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা যদি গঠনমূলক ও সৃজনশীল হতাম, তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেও অনেক কিছু শেখার ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখার যে একেবারে কিছু নেই তা বলছি না, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় একে অন্যকে হেয় করা কিংবা অপমান করার ক্ষেত্রেও মাধ্যমগুলো ব্যবহার হচ্ছে। মাধ্যমগুলো হতে পারে একটি বড় শিক্ষণ মাধ্যম, যদি আমরা এগুলোকে নিজে এবং অন্যকে শেখানোর কাজে ব্যবহার করি। এর সঠিক ব্যবহার পারে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, একটি সৃষ্টিশীল পরিবার ও একটি উন্নত সমাজ উপহার দিতে। আসুন আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বিকৃতি ও ভুল উপস্থাপনা থেকে দূরে রাখি। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে সুন্দরভাবে চলতে দিই। নিজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রকের বাহক হিসেবে কাজ করি এবং এর যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করি।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়