বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীদের বড় অংশের প্রথম পছন্দ সরকারি চাকরি। চাকরি শেষে সারা জীবন পেনশন নিরাপত্তার মতো সুবিধা এত দিন শুধু সরকারি চাকরিতেই ছিল। তবে মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল বেসরকারি খাতেও পেনশনব্যবস্থা চালুর। অবশেষে সরকারি সুবিধার মতো না হলেও নিজের জমানো টাকায় বহুল প্রত্যাশিত বেসরকারি খাতের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি (স্কিম) চালু করেছে সরকার।
বৃহস্পতিবার এই কর্মসূচি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ফলে সবার জন্য সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি উন্মুক্ত হয়েছে, যা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।
চারটি স্কিম
সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আপাতত চার ধরনের স্কিম চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি স্কিম, প্রবাসীদের জন্য প্রবাস স্কিম, অনানুষ্ঠানিক খাত অর্থাৎ স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা স্কিম আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রয়েছে সমতা স্কিম।
এরই মধ্যে পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট (www.upension.gov.bd) চালু হয়েছে। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আজ থেকে যে কেউ পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করে আপনার ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।’
কত মানুষ আসবে স্কিমের আওতায়
দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা।
অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল এক কোটি ২০ লাখ এবং ২০৪১ সালে সেই সংখ্যা হবে তিন কোটি ১০ লাখ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে স্কিম চালু করা হয়েছে।
কারা আবেদন করতে পারবেন
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বকর্মে নিয়োজিত ও স্বল্প আয়ের নাগরিক ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা এতে অংশ নিতে পারবেন। তবে কর্মরত সরকারি চাকরিজীবীরা আপাতত এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারছেন না। এই স্কিম থেকে বাদ পড়ছেন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাপ্রাপ্ত এক কোটি ৩৮ লাখ মানুষ।
তাঁদের সবাই নগদ ভাতার সুবিধা পাচ্ছেন। পেনশন স্কিমে অংশ নিতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা সমর্পণ করতে হবে।
যেভাবে নিবন্ধন
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে গেলে ইউপেনশন ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। দেশে-বিদেশে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ফরম অনলাইনে পূরণ করে আবেদন করতে পারবেন। সেই আবেদনের বিপরীতে একটি ইউনিক আইডেন্টিটি নম্বর (ইউআইডি) দেওয়া হবে। আবেদনে উল্লেখ থাকা আবেদনকারীর মোবাইল নম্বর এবং অনিবাসীদের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় ই-মেইলের মাধ্যমে ইউআইডি নম্বর, চাঁদার হার এবং মাসিক চাঁদা দেওয়ার তারিখ জানানো হবে। পেনশন কর্তৃপক্ষ বলেছে, ভুল তথ্য দিয়ে আবেদন করলে সেই আবেদন বাতিল হবে এবং জমা করা অর্থ ফেরতযোগ্য হবে না।
যেসব কাগজপত্র লাগবে
পেনশনব্যবস্থার আওতায় আসতে গেলে একজন আবেদনকারীর অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশি যাঁদের এনআইডি নেই, তাঁরা পাসপোর্টের ভিত্তিতে এই পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারবেন। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এনআইডি সংগ্রহ করে পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে তা জমা দিতে হবে।
চাঁদা জমা যেভাবে
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিধিমালায় বলা হয়েছে, পেনশনের চাঁদা জমা দিতে হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে। আর জমা দেওয়া যাবে অনলাইন ব্যাংক, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ও তফসিলি ব্যাংকের যেকোনো শাখার মাধ্যমে। চারটি স্কিমের জন্য আলাদা চারটি হিসাব খোলা হয়েছে সোনালী ব্যাংকে। এ হিসাবগুলোতে চাঁদা জমা হবে। সোনালী ব্যাংক দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরে অন্য ব্যাংকও যুক্ত হবে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বলেছেন, ‘দেশের ভেতরে আমাদের ব্যাংকের এক হাজার ২২৯টি শাখাই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। পেনশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমাদের চুক্তি হয়েছে।’
কত জমা দিয়ে কত পাওয়া যাবে
সরকারঘোষিত চার ধরনের পেনশন কর্মসূচির মধ্যে প্রবাস কর্মসূচিতে একজন ১৮ বছর বয়সী প্রবাসী যদি মাসে ১০ হাজার টাকা করে জমা দেন, তবে ৪২ বছর পর তিনি প্রতি মাসে পাবেন তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা করে। আবার ১৮ বছর বয়সী বেসরকারি কোনো চাকরিজীবী যদি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে জমা দেন, তাহলে তিনি ৪২ বছর পর মাসে পাবেন এক লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে। সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায়ও ১৮ বছর বয়সী কেউ যদি পাঁচ হাজার টাকা করে মাসে জমা দিয়ে পেনশনে যুক্ত হন, তাহলে ৪২ বছর শেষে তিনিও মাসে এক লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পাবেন।
তবে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য নির্ধারিত সমতা পেনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের মাসিক চাঁদার অর্ধেক দেবে সরকার। সমতা কর্মসূচিতে একজন অংশগ্রহণকারীকে মাসে দিতে হবে ৫০০ টাকা, এর বিপরীতে সরকার দেবে আরো ৫০০ টাকা। এভাবে কেউ যদি ৪২ বছর এক হাজার টাকা করে জমা দেন, তাহলে মেয়াদ শেষে তিনি মাসে পেনশন পাবেন ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা করে।
আছে ঋণ সুবিধা
চাঁদাদাতা মোট জমানো অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন। এটি পরবর্তী ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া এই স্কিমের আওতায় চাঁদাদাতা স্কিমের স্বত্ব অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে পারবেন না। তবে স্কিম চলাকালীন কেউ মারা গেলে মনোনীত নমিনির নামে হস্তান্তর করা যাবে।
৭৫ বছর বয়সের আগে কোনো পেনশনার মারা গেলে তাঁর নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের পেনশন প্রাপ্য হবেন। ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে কোনো পেনশনার মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে দেওয়া হবে। বিনিয়োগ বিবেচনায় পেনশনের চাঁদা কর রেয়াতযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মাসিক পেনশন বাবদ পাওয়া অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।
ব্যবস্থাপনা হবে যেভাবে
পেনশনব্যবস্থা পরিচালনা ও বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা অর্থ বিভাগের অধীন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট চালু হয়েছে গত ১৬ আগস্ট। পেনশন বাবদ জমা করা অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে একটি ‘সর্বজনীন পেনশন তহবিল’ গঠন করা হবে। এই তহবিলে চাঁদা জমা, হিসাব সংরক্ষণ, পুঞ্জীভূত অর্থের সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিনিয়োগ, পেনশন দেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম হবে। এক বা একাধিক তফসিলি ব্যাংকে তহবিলের অর্থ রাখা যাবে।
জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘গরিবদের জন্য শতভাগ চাঁদা পরিশোধ করবে—এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে। কিন্তু সেটি রাখতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাপ্রাপ্যদের এখানে আনতে হলে সমপরিমাণ সুবিধা দিতে হবে।’
সময়মতো চাঁদা না দিলে
নির্ধারিত তারিখের মধ্যে চাঁদা জমা দিতে না পারলে পরবর্তী এক মাস পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া চাঁদা জমা দেওয়া যাবে। এক মাস পার হলে পরবর্তী প্রতিদিনের জন্য ১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি জমা দিয়ে হিসাব সচল রাখা যাবে। কোনো চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে তিন কিস্তির চাঁদা জমা না দিলে তাঁর পেনশন হিসাব স্থগিত হবে। তবে নির্ধারিত বিলম্ব ফিসহ চাঁদা জমা দিয়ে হিসাব সচল করা যাবে। মাসের নাম উল্লেখ করে যেকোনো পরিমাণ চাঁদার টাকা আগাম জমা দেওয়া যাবে।
কোনো চাঁদাদাতা চাঁদা প্রদানকালে শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যের কারণে স্থায়ী বা সাময়িকভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্মহীন ও উপার্জনে অসমর্থ হলে তাঁকে অসচ্ছল চাঁদাদাতা হিসেবে ঘোষণার জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করতে পারবেন। অসচ্ছল চাঁদাদাতা হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর ১২ মাস পর্যন্ত চাঁদা না দিলেও পেনশন হিসাব স্থগিত হবে না।
আরো দুটি স্কিম আসবে
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি চাকরিজীবী এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরতদের জন্যও সর্বজনীন পেনশনের দুটি স্কিম তৈরি করা হয়েছে। এ দুটি আপাতত চালু করছে না সরকার। কারণ সরকারি চাকরিজীবীরা বর্তমানে সরকার থেকে পেনশন পাচ্ছেন। আর স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত কম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্র্যাচুইটিসহ অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন। এগুলো পর্যায়ক্রমে চালু হবে।
প্রথম দিন যাঁরা নিবন্ধন করলেন
সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছেন বরগুনা পৌর শহরের চরকলোনী এলাকার সাবরিনা আখতার এবং বরগুনা সদরের বুড়িরচর ইউনিয়নের দক্ষিণ বড় লবণগোলা এলাকার রফিক কাজী।
সাবরিনা আখতার বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন আছে। আমাদের পেনশন সুবিধা নেই। সরকার সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করেছে, তা আমাদের বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।’
মত্স্যজীবী রফিক কাজী বলেন, ‘সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে। এটি আমাদের জন্য অনেক সুফল বয়ে আনবে। আমার পরিবারের অনেক কাজে লাগবে।’
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার মানিকদাহ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা দুলালী আক্তার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধনের পরপরই রেজিস্ট্রেশন করেছি। রেজিস্ট্রেশন করতে কোনো সমস্যা হয়নি। বৃদ্ধ বয়সে চলার একটা পথ হবে।’