সাগরকন্যা কুয়াকাটা। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এখানকার সৈকত। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সৈকতের পানিতে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের দৃশ্য। এত সৌন্দর্যের ভিড়ে পর্যটকদের কাছে আলাদা জায়গা করে নিচ্ছে রাখাইন পল্লি। এখানকার সমাজভিত্তিক পর্যটন বদলে দিচ্ছে রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবন।
কুয়াকাটা সৈকত থেকে সড়কপথে আট কিলোমিটার পাড়ি দিলেই মিশ্রীপাড়া। প্রলয়ঙ্করী সিডরের পর এখানে ইন্দোচীন সৌকর্যের আদলে সংস্কার করা হয় সীমা বৌদ্ধ বিহার। এতে যেমন বিহারের সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে যায়, তেমনি ১৫০ বছরের পুরোনো প্রায় ৪০ ফুট উচ্চতার গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি ঘিরে গড়ে ওঠে সমাজভিত্তিক পর্যটন।
মিশ্রীপাড়ার পল্লিতে ২২ রাখাইন পরিবারের বসবাস। কৃষিভিত্তিক এই সম্প্রদায়ের জীবিকায় শস্য, মহুয়ার (মদ) পরিবর্তে এখন জায়গা করে নিয়েছে পর্যটন। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক ও দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর থাকছে বিহার ও রাখাইন পল্লি। আগতদের জন্য রাখাইন পরিবারগুলো এখন নানা রকম পিঠা-পুলি, তাঁত পোশাক, বার্মিজ আচার, চাটনিসহ নানা পণ্যের পসরা সাজাচ্ছে। আয় ভালো হওয়ায় সন্তানদের পড়ালেখা করাচ্ছেন অভিভাবকরা।
মিশ্রীপাড়া পল্লির মাতুব্বর আফব্রু রাখাইন বলেন, সমাজভিত্তিক পর্যটন রাখাইন সম্প্রদায়ের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। সীমা বিহারাধ্যক্ষ উত্তম ভিক্ষু বলেছেন, ১৫০ বছর আগে রাখাইন মিশ্রী মং দুই একর জায়গায় সীমা বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। সিডরের পর জার্মান দূতাবাসের সহায়তায় ইন্দোচীন সৌকর্যের আদলে বিহার সংস্কার করা হয়। এখানে রয়েছে বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণে দৃষ্টিনন্দন কুয়া, ফুল ও ফলদ গাছের বাগান। দর্শনার্থীদের অনুদানে চলছে পাঠশালা, যেখানে সব ধর্মের শিশুরা বিনামূল্যে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে।
একই রকম পরিবর্তন এসেছে কুয়াকাটা পৌরসভার প্রাণকেন্দ্র কেরানীপাড়া রাখাইন পল্লির ২৭টি পরিবারের ক্ষেত্রে। শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার ও কুয়াকাটা নামকরণের কুয়া ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন তাদের জীবন-জীবিকা বদলে দিয়েছে। এখানে কুয়াকাটা রাখাইন মহিলা মার্কেট ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য হোটেল-মোটেল। একটু দূরেই আলীপুর সামুদ্রিক মাছের পাইকারি বাজারের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছেন কালাচাঁনপাড়ার রাখাইনরা। তবে এখনও পর্যটনের আওতায় আসেনি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাখাইন পল্লি গোড়া আমখোলাপাড়া, যেখানে বসবাস ৪৮ পরিবারের। পল্লির মাতুব্বর প্রকৌশলী ম্যাথুজ রাখাইন বলেন, মিশ্রীপাড়া, কোরানীপাড়া ও কালাচাঁনপাড়ার মতো এখানে সমাজভিত্তিক পর্যটন বাড়ানো গেলে কুয়াকাটায় পর্যটকদের আনাগোনা আরও বাড়বে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, গোড়া আমখোলা রাখাইন পল্লিতে রাখাইন সংস্কৃতি চর্চায় কালচার একাডেমি ও শায়িত মূর্তি নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।
পটুয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও লেখক ওহাব মিয়া বলেন, রাখাইন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্মীয় রীতিনীতি খুবই সমৃদ্ধ। গহিন অরণ্যকে বাসযোগ্য করা এবং হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকার গল্প অনবদ্য। পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। সরকারের উচিত এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথিন প্রমীলা বলেন, সমাজভিত্তিক পর্যটন রাখাইনদের জীবন বদলে দিচ্ছে। কিন্তু যে পর্যটন আমাদের দেবালয়, মরদেহ সৎকারের শ্মশানটুকু কেড়ে নেয়, তা আমরা চাই না। পর্যটনের প্রসার ঘটাতে হলে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করেই করতে হবে।
ট্যুর অপারেটর অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন আনু বলেন, রাখাইনদের আরও ১০টি পল্লিতে সমাজভিত্তিক পর্যটন চালু করা দরকার। তাদের ঐতিহ্যগত টংঘরের ভৌত অবকাঠামে উন্নয়ন করলে পর্যটকদের বাড়তি মনোযোগ কাড়বে।
কুয়াকাটা সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, কমিউনিটিভিত্তিক পর্যটন চালুর বিষয় সরকারের ভাবনায় রয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় কুয়াকাটার পর্যটন শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করা হবে।