প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে কোন গ্রহণযোগ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়েই উঠেনি। করোনাকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভয়ংকর দিকগুলো ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যম একটি অদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, কারণ গণমাধ্যমে লেখালেখিকে সরকার এক ধরনের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিয়ে থাকে। উদীয়মান গণতন্ত্রে গণমাধ্যমকে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় বাংলাদেশে সেই চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। হেলথ জার্নালিজম এর জন্য দেশে আলাদাভাবে কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যখাত নিয়ে রিপোর্টিং এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এগিয়ে আসলে তার মান আরো ভালো হবে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো বাংলাদেশে কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য তথ্য দেয়ার জন্য কোন কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে তথ্যের সত্যতা যাচাইয়েরও কোন সুযোগ নেই। আর এভাবেই সূচনা হয় গুজব কিংবা বিভ্রান্তির।
রবিবার (৩০ মে) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং মিডিয়ার ভূমিকা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আলোচকরা এসব মতামত ব্যক্ত করেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন দৈনিক ভোরের কাগজ এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত, চিকিৎসক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডা. আব্দুন নূর তুষার এবং যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এর ক্লিনিকাল প্রাক্টিশনার, মেডিকেল এক্টিভিস্ট ডা. সালমা হাসান।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে কোন গ্রহণযোগ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়েই উঠেনি মন্তব্য করে শ্যামল দত্ত বলেন, করোনাকালের আগে থেকেই এর অবস্থা ছিল নাজুক। কিন্তু করোনাকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভয়ংকর দিকগুলো ফুটে উঠেছে। দেশের স্বাস্থ্যখাত আগেও ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত এবং তা ছিল গণমাধ্যমে লেখালেখির জন্য আকর্ষণীয় এক বিষয়। কিন্তু করোনাকালে তার আরো ভয়ংকর দিকগুলো উন্মোচিত হয়। ধনাঢ্য বা ভিআইপিদের বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বন্ধ হলে সকলের চোখে পড়ে দেশের স্বাস্ত্যখাতের দশা কি করুণ! নকল করোনা সনদ দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে দেশে। গণমাধ্যম এসব তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। গণমাধ্যম প্রত্যাশা করেছিল যে এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে, কিন্তু হতাশার সাথে সবাই দেখলেন, তেমন কোন ব্যবস্থাতো নেয়াই হয়নি, উল্টো বলা হচ্ছে করোনা মোকাবিলায় আমরা সফল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে গণমাধ্যম একটি অদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, কারণ গণমাধ্যমে লেখালেখিকে সরকার এক ধরনের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিয়ে থাকে। এ কারণে অনেকেই নিরুৎসাহিত হন। গণমাধ্যম যে সরকারের উন্নয়নের সহযোগী এবং গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য বিষয় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বোধোদয় নেই। যে কারণে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে যে পরিমাণ সময় বা শ্রম দিতে হয় সেটি আর কেউ করতে চান না। কারণ রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নানামুখী চাপ থাকে। একটি উদীয়মান গণতন্ত্রে গণমাধ্যমকে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় বাংলাদেশে সেই চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ঘটনাবলীতে তা আরো বেশি প্রতীয়মান। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এসবের মধ্যেও তার সাহসী ভূমিকা রেখে চলেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নানা রিপোর্ট হচ্ছে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতি গণমাধ্যমের জন্য অত্যন্ত কঠিন এক সময়।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে গণমাধ্যমের ক্রমাগত এবং তাৎক্ষণিক দুই ধরনের দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করেন ডা. তুষার। ক্রমাগত দায়িত্ব হলো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা। এছাড়া যারা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বুঝেন তাদের লেখা ছাপিয়ে, বিভিন্ন গবেষণামূলক নিবন্ধ বা প্রবন্ধ প্রকাশ করে মানুষকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করা। তাছাড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সংস্কারের জন্যও উদ্বুদ্ধ করাও ওর মধ্যে পড়ে। আর তাৎক্ষণিক দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির সংক্রান্ত রিপোর্ট, মহামারী সংক্রান্ত রিপোর্ট, নতুন কোন রোগ বা সমস্যা সংক্রান্ত রিপোর্ট করা ইত্যাদি।
তার মতে, দুর্নীতির, অব্যবস্থাপনা ও নানা ধরনের সমস্যা সংক্রান্ত রিপোর্ট-ই সাধারণত টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রে বেশি প্রচারিত হয়। এফএম রেডিওগুলো এসবে ততোটা গুরুত্ব দেয় না। সারাদেশে সম্প্রচারিত হওয়া একমাত্র রেডিও হলো বাংলাদেশ বেতার। কিন্তু সরকারি রেডিও হিসেবে এসব বিষয়ে তারা কখনো দৃষ্টিপাত করেন না।টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলেও ইদানীং করোনাকালে সেসব অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কেননা একেক টেলিভিশন বা পত্রিকা একেক বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন বা গুরুত্ব দিয়েছে, একেক জায়গায় থেকে একেক তথ্য এসেছে। এর কারণ করোনাকালে কোন কেন্দ্রীয় তথ্য প্রদান ব্যবস্থা সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট করতে পারে নি। তাদের নিজেদের মধ্যেই অনেক দ্বন্দ্ব, অনেক দ্বিধা, অনেক সন্দেহ দেখা গেছে। গণমাধ্যম দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নিজেরাই যদি দ্বিধা বা সন্দেহের মধ্যে থাকেন, তাদের নিজেদের মধ্যেই যদি একে অপরের সাথে মিল না থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই একেক টেলিভিশন বা পত্রিকা একেক তথ্য বা পরিসংখ্যান বেছে নেবে। তাই হয়েছে এবং এ কারণে সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত হয়েছে। এসব কিছু হয়েছে তথ্যবিভ্রাটের জন্য এবং সেজন্য গণমাধ্যম দায়ী নয়। কেননা গণমাধ্যম নিজেই একেক সময় দায়িত্বশীলদের একেক রকম কথায় বিভ্রান্ত হয়েছে।
আগে মানুষ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খবর কম পড়লেও বা রাখলেও করোনাকালে তা বহুগুণ বেড়েছে বলে মনে করেন ডা. সালমা। তিনি মনে করেন বিশ্বের অন্যান্য দেশ কিভাবে মহামারী মোকাবিলা করছে তা নিয়ে রিপোর্ট করতে টেলিভিশন বা পত্রিকায় আলাদা টিম রাখা যাতে পারে৷ শুধু দুর্নীতি-ই নয়, আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে ভালো রিপোর্ট করা যেতে পারে। করোনাকেলে দেশে অনেক সাধারণ মানুষ অনেক সমাজসেবামূলক কাজ করেছেন বা করছেন সেগুলো গুরুত্বসহকারে প্রচার করলে মানুষ অনুপ্রাণিত হবে।
হেলথ জার্নালিজম এর জন্য দেশে আলাদাভাবে কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই বলে জানান শ্যামল দত্ত। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের সংগঠন ‘হেলথ জার্নালিস্ট ফোরাম’ এর সদস্যরা নানাবিধ প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। কিন্তু এসব প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো প্রশিক্ষকের বড় অভাব। প্রথাগত রিপোর্টিং এর বাইরে ভিন্ন কিছু করতে গেলে বিশেষজ্ঞ মতামত পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে রিপোর্টিং এর জন্য ভালো একটি সাংবাদিক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যখাত নিয়ে রিপোর্টিং এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এগিয়ে আসলে তার মান আরো ভালো হবে। করোনাকালে গুজব, ভুল ধারণা, বিভ্রান্তি এসব সমস্যাও মোকাবিলা করতে হয়েছে গণমাধ্যমকে।
ডা. তুষার বলেন, ইউরোপ-আমেরিকার মতো বাংলাদেশে কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য তথ্য দেয়ার জন্য কোন কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে তথ্যের সত্যতা যাচাইয়েরও কোন সুযোগ নেই। আর এভাবেই সূচনা হয় গুজব কিংবা বিভ্রান্তির। স্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য না পেলেও কেউ যদি পরস্পরবিরোধী বা অযৌক্তিক কোন দাবি তুলে ধরে তাহলে সে বিষয়ে গণমাধ্যম প্রশ্ন করছে না। স্বাস্থ্য বিট কাভার করা সাংবাদিকদের জন্য চিকিৎসক বা এক্ষেত্রে দক্ষ সাংবাদিকদের নিয়ে সেমিনার বা প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে৷ সরকারের অন্তত উচিত ছিল সরকারি হাসপাতালগুলোর রেটিং করা, বেসরকারিগুলোকে মনিটরিং করা, তাদের কাজের মূল্যায়ন করা।
তবে, ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য তথ্য দেয়ার জন্য কোন কর্তৃপক্ষ না থাকলেও বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতের একটি সত্যিকার ডেটাবেজ করা যেতে পারে বলে মনে করেন ডা. সালমা। তার মতে, এক্ষত্রে প্রবীণ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের উচিত কনিষ্ঠদের উৎসাহ দেয়া, সহায়তা করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়াতে পারে কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যমে গুজব ছড়ানোটা অনাকাঙ্ক্ষিত। হেলথ জার্নালিজম উৎসাহ ‘না পাওয়ার মতো’ কোন পেশা নয় বরং এর মাধ্যমে মানুষকে সরাসরি সাহায্য করার অবকাশ রয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নগরকেন্দ্রিক এবং সেটাও মাত্র কয়েকটি নগরকেন্দ্রিক। ফলে এক্ষেত্রে সাংবাদিকতাও বহুমাত্রিকতা পায় নি। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যেহেতু মানবাধিকার সরকারের এ খাতে তাই আরো বেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন শ্যামল দত্ত। তার মতে, এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। নাম উল্লেখ করে দেশে স্বাস্থ্যবিটে কাজ করেন এমন অনেক ভালো সাংবাদিক রয়েছেন বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন যদিও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাত নিয়ে সাংবাদিকতা করতে হলে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। কিন্তু আজকাল সাংবাদিকরা পড়াশোনা করতে চান না। এটা গণমাধ্যমের একটা বড় সীমাবদ্ধতা৷
যে কোন সাংবাদিককেই প্রশিক্ষণ ছাড়া স্বাস্থ্যবিটে পাঠানো উচিত নয় এবং কিছুদিন তাকে দক্ষ কারো তত্বাবধান করা উচিত বলে মনে করে ডা. তুষার। তার প্রস্তাব- প্রত্যেক পত্রিকায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড রাখা যেতে পারে যাতে কোন সাংবাদিকের এ নিয়ে কোন প্রশ্ন জাগলে তা তাদের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য বিষয়ে যারা জানেন না তাদের যেনো কোনভাবেই এই খাত নিয়ে রিপোর্টিং এ পাঠানো না হয় এই অনুরোধ করেন সালমা।