আজ আইয়ুব বাচ্চু’র জন্মবার্ষিকী। প্রয়াত যে কারোর জন্মবার্ষিকীতে মূলত সেই মানুষটিকে আলোচ্য হিসেবে আনা হয় তার স্মৃতির ঘরে কিছুটা পায়চারির উদ্দেশ্যেই। একজন আইয়ুব বাচ্চু গত তিনদশক ধরে যে ভালোবাসা বিলিয়েছেন তার সুরে, শিল্পী তৈরি করে বা নিজের ব্যক্তিগত সহমর্মিতায়। তার তুলনা চলে না। কিন্তু তাঁর এই না থাকা জুড়ে যে বড় হাহাকার, তা অনুভব করেন এদেশের লাখ লাখ তরুনেরা। সে তরুন মিউজিশিয়ান হোক বা পাড়া মফস্বলের সাধারণ যুবক হোক।
সারা বছর জুড়ে একজন আইয়ুব বাচ্চু বিভিন্ন কলেজের নবীন বরণে যে কয়েকশত কনসার্ট করেছেন তার প্রতিটিতে তিনি মূলত ব্যক্তি আইয়ুব বাচ্চু’র সারল্যের বীজ বুনেছেন। রকস্টার হাসান যেমন তাকে স্মরণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। বলেন,‘আমি যখন একেবারেই নতুন। সেই সময় আমার গান শুনে বাচ্চু ভাই জড়িয়ে ধরেছিলেন।
বলেছিলেন- হাসান তোর আত্মার ভেতরে একটা প্রেম আছে। এই প্রেমটা সবাইকে দিস। সেই থেকে আমি রকস্টার।’ এরকম অনেককেই লিখিত অলিখিত ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আমরা হয়তো আলোচ্য হিসেবে জানি হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল, কানিজ সূবর্ণা, আগুন, এস আই টুটুল, রুপম থেকে শুরু করে একগুচ্ছ শিল্পীর নাম। যাদের নিজ হাতে একজন আইয়ুব বাচ্চু তারকা বানিয়েছেন। কিন্তু এর বাইরে অপ্রকাশিত ভাবে কাউকে গিটার দিয়ে, কাউকে বিভিন্ন জায়গায় রেফার করে সাহায্য করেছেন। এসবের একবিন্দুও প্রচার নেননি এই মানুষটি। অনেকের কাছেই আর্থিকভাবে ঠকেছেন। ক্ষমা করে দিয়েছেন নিঃশর্তে। কাউকে বলেননি। ঢাকায় আইয়ুব বাচ্চু’র স্টুডিও এবিকিচেন ছিল মূলত এক ভালোবাসার ঘর। সবার জন্য উন্মুক্ত। ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক মিউজিশিয়ানের বাইরের মানুষকে দেখেছি, বিভিন্ন সংকট বা ছেলের চাকরী বা নিজের বিভিন্ন সমস্যার পথ খুঁজতে এসেছেন আইয়ুব বাচ্চুর কাছে।
আইয়ুব বাচ্চু হয়তো কোনো এক আড্ডায় তাকে বলেছেন দেখা করিস। তিনি চলে এসেছেন। কাউকেই তিনি ফেরাতেন না। তাই তরুনদের কাছে একবুক হাহাকারের নাম আজ ‘আইয়ুব বাচ্চু’। কারণ যে কোনো সংকটে, আলোচনায় বা তর্কে তরুণ একজন মিউজিক লাভারের কাছে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন এক সুশীতল আশ্রয়ের নাম। না, কোনো সংগঠনেরই তিনি নেতৃত্ব দেননি বা দিতে চাননি। কিন্তু তিনি ছিলেন অলিখিত রাজা। যার দরবারে ভালোবাসা কিনতে যেত মানুষ। আইয়ুব বাচ্চুর খুব ঘনিষ্ঠ, দীর্ঘদিনের সহযাত্রী বামবা সভাপতি এক আড্ডায় অনুজপ্রতিম বন্ধুকে স্মরণ করতে গিয়ে বলেন,‘ওকে আমি বারবার বামবার নেতৃত্ব নিতে বলেছি। বাচ্চুই বলেছে, আপনি ছাড়া হবে না। যে কোনো উদ্যোগে ওর উত্সাহটা সবচেয়ে বেশি কাজে দিতো। একটা মানুষ ২৪ টা ঘন্টা এই ব্যান্ড মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে ভাবতেন তাঁর নাম আইয়ুব বাচ্চু।’
শিল্পীর খুব কাছের মানুষ ছিলেন গীতিকবি নিয়াজ আহমেদ অংশু। ভীষণ আদর করতেন এই জনপ্রিয় গীতিকবিকে। দেশ ছেড়ে অংশু অস্ট্রেলিয়া চলে গেলে সেখানেও তাদের অগনিত আড্ডার স্মৃতি জমেছে অনেক। অংশু তাই আইয়ুব বাচ্চুকে হারানোটা তার জীবনের পিতৃহারা শোকের মতোই অনুধাবন করেন। বয়ে বেড়ান জীবনের স্মৃতিশ্লোক। এমন ঘটনা, স্মৃতি, শ্রদ্ধার গল্প অগনিত এই মানুষটিকে ঘিরে।
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু বললেন ভালো খেলিস দেশের মান ইজ্জত রাখিস: সালাহউদ্দিন
আজ এই মহীরুহর জন্মবার্ষিকীতে তাই তার প্রতি শুধুই প্রার্থনা। অগনিত কেক আর ফুল উপহারের দীর্ঘ লাইন হয়ত বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তাকে মিস করে, বুকের ভেতরে এক দারুণ অনুভব, এক মায়ার কোরাস বেড়েছে অনেক। প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু, ভালোবাসা নেবেন। ভালো থাকুন আপনি। আপনি সুরের যে মায়াজাল ছড়িয়ে গেছেন এই বিশ্ব বাংলার আকাশজুড়ে। সেই জালে কয়েক সহশ্র শতক পার করতে পারবে বাঙালি। সেই সুরের স্পর্শে আসবে হয়ত কারো কারো প্রেম, কারো বিরহী মনের অনুভব, কারো উন্মাতাল আনন্দে অবগাহনের সুখ। কারণ একজন আইয়ুব বাচ্চু তার সুরের ভেতর দিয়ে নানান অনুভুতিন বুনন তৈরি করে গেছেন। যাকে চাইলেও উপেক্ষা করা অসম্ভব!