লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাকস্বাধীনতা, মানবিক অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা। দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। অবসরগ্রহণের পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ‘প্রফেসর এমেরিটাস’ হিসাবে মনোনীত হয়েছেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য যাদের নিরলস অবদানে সমৃদ্ধ তিনি তাদের অন্যতম। তিনি ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। শিক্ষায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। একান্ত সাক্ষাৎকারে খ্যাতনামা এই শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তক কথা বলেছেন বর্তমান সময়, রাজনীতি নিয়েও।
প্রশ্ন: ছেলেবেলায় আপনি কি হতে চেয়েছিলেন?
উত্তর: ট্রেন চালক। আমার ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহীতে। ট্রেনের ড্রাইভারকে দেখতাম তার ট্রেন চালিয়ে দূর দূরান্তে চলে যেতে। তাই দেখে খুব ইচ্ছে করতো ট্রেনের চালক হতে।
প্রশ্ন: লেখক হবার ইচ্ছেটা কখন জাগলো?
উত্তর: রাজশাহীতে দৈনিক আজাদ পত্রিকা আসতে সন্ধা হয়ে যেতো। সেখানে একটি ছোটদের পাতা ছিল নাম ‘মুকুলের মাহফিল’। সেটি পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। এরপর কলকাতায় গেলে ইত্তেহাদ পত্রিকার কিশোর পাতার নিয়মিত পাঠক হয়ে যাই। মেট্রিক পরীক্ষার বন্ধে আজিমপুরে থাকতে পলাশী নজরুল লাইব্রেরি থেকে প্রচুর বই পড়েছি। দশম শ্রেণিতে আমার বন্ধু (লেখক-সাংবাদিক) শফিক রেহমানের হাতে লেখা পত্রিকাতে নিয়মিত লিখতাম।
আজিমপুর সরকারি কলোনিতে অন্যসব ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমরা ‘আজিমপুর কলোনি ছাত্রসংঘ’ নামে একটি পাঠাগার গড়ে তুলি। তখন আবার রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী একসাথে পালন করতাম। আমরা স্বপ্ন দেখতাম রবীন্দ্র-নজরুলের সাথে এদেশে সুকান্তও থাকবে। আমরা একটি দেয়াল পত্রিকাও বের করতাম ‘ঝামেলা’ নামে। ‘রাঙ্গাপ্রভাত’ নামে একটি হাতেলেখা পত্রিকাও আমি সম্পাদনা করতাম যেখানে মুনীর চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমানদের লেখা ছাপা হতো।
প্রশ্ন: শৈশবের কোন মজার স্মৃতি?
উত্তর: আমার শৈশবের সব স্মৃতিই নদীকে ঘিরে। যেখানেই ছিলাম সাথী ছিল কোন না কোন নদী। ছোটবেলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টায় থাকতাম ইছামতী নদীর কাছে। তারপর রাজশাহীতে ছিলাম পদ্মা নদীর পাড়ে। কলকাতায় ছিলাম গঙ্গার ধারে। এরপর ঢাকায় পেলাম বুড়িগঙ্গা নদীকে।
মজার স্মৃতি বলতে হয়, রাজশাহী কলেজের মুসলিম হোস্টেলে বাবার সঙ্গে যেতাম নাটক দেখতে। তখন রাজশাহীতে সিনেমা হল ছিল দুটি। অলোকা আর ছায়াবাণী। আমার দেখা প্রথম সিনেমা ‘সাত নম্বর বাড়ি’। তখন ছিল চিত্তবিনোদনের বড় অভাব। কলকাতায় গিয়ে অবশ্য গড়ের মাঠ পেয়েছিলাম। আর সিনেমা হলতো ছিলই।
দেশবিভাগের সময় কলকাতার মুসলিমদের ৫০ ভাগ এদেশে চলে আসলো। বেশিরভাগই আসতো পদ্মায় স্টিমারে চড়ে। আমরাও এসেছিলাম, আর সেটাই ছিল আমার প্রথম স্টিমারে চড়া। এটা একটা মজার অভিজ্ঞতা ছিল।
প্রশ্ন: দেশবিভাগের বিষয়টি সেসময় আপনার কাছে কেমন লেগেছিল?
উত্তর: তেমন বড় কিছু মনে হয় নি। ১৯৪৮ এ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জিন্নাহ এর দেয়া বক্তব্য ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ আমি নিজ কানে শুনেছি। বাবারা তখন আক্ষেপ করে বলতেন- স্বাধীনতা এসেছে নাজিমউদ্দিনের জন্য। আমি সেন্ট গ্রেগরি ¯ু‹লে পড়তাম। তখনকার সময় সেটিই ছিল সবেচেয়ে ভালো স্কুল। ১৯৫০ এ যখন সেখান থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছিলাম তখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেঁধে গেল। আমার সঙ্গের অনেক হিন্দু ছাত্র ভয়ে পরীক্ষা দিতে এলো না। বিষয়টি মর্মাহত করেছিল। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ঢাকা মেডিকেলের সামনের আমতলার জমায়েতে আমি ছিলাম। পুলিশ আমাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে। এরকম অভিজ্ঞতা আগে আমার কখনো ছিল না। যাই হোক, পুকুরে গিয়ে রুমাল ভিজিয়ে দুচোখ মুছে বাসায় চলে যাই।
প্রশ্ন: আশির দশকে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, এমন নাম ধারণের কারণ কি ছিল?
উত্তর: শুধু গাছপাথরই নয়। আমি মাসিক পত্রিকা পূবালীতে ‘নাগরিক’ এবং দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ‘মৃদুভাষী’ ছদ্মনামে লিখতাম। ছদ্মনাম ধারণের একটা মজা ছিল। তখনতো পত্রিকার সংখ্যা ছিল হাতেগোণা। দেখা যেতো বাসে করে যাচ্ছি, আমার পাশে বসে কেউ আমার লেখাই পড়ছে অথচ চিনতেও পারছে না মানুষটি আমি। আর ছদ্মনামে লিখলে স্বাধীনতা পাওয়ার বিষয়টিতো ছিলই।
গাছপাথরের কথা বলতে গিয়ে গাছের কথায় আসি। বাংলাদেশে গাছপালা তথা বনভূমি কেটে উজাড় করা হচ্ছে। ঢাকা শহরের উদ্যানের সংখ্যাও দিনদিন কমে যাচ্ছে। এসব নিয়ে আমি সবসময় সোচ্চার ছিলাম। ২০০২ সালে ‘ওসমানী উদ্যানের এগারো হাজার গাছ রক্ষা আন্দোলন’ এর আমি ছিলাম আহ্বায়ক। আমরা উদ্যানটিকে বলতাম ঢাকা শহরের ফুসফুস। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র কিন্তু ওখানেই হবার কথা ছিল। আমাদের আন্দোলন সফল হয়েছিল। সম্মেলন কেন্দ্রটি সেখানে হয়নি। এখানে উল্লেখ্য আমরা আন্দোলনকারীরা মানুষ ছিলাম কম কিন্তু জনসমর্থন ছিল বিপুল। আসলে জনসমর্থন থাকলে যে কোন আন্দোলনই সাফল্য লাভ করে। ‘লালন আখড়া আন্দোলন’ এরও আমি আহ্বায়ক ছিলাম। কবি শামসুর রাহমান এর আহ্বায়ক থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাজ চালাতে না পারলে আমি সে দায়িত্ব পালন করি।
আমাদের স্বপ্ন ছিল ঢাকা শহরের সব পার্কই একদিন অবমুক্ত হবে। এখনতো মানুষ প্রকৃতিকে মুনাফার বস্তুতে পরিণত করেছে।
প্রশ্ন: গাছপালা কাটার পেছনে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতো একটি বড় কারণ। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু পদক্ষেপ কখনো কি নেয়া হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর: দেশবিভাগের পর ঢাকায় প্রচুর লোক আসলো, বিশেষ করে ভারত থেকে মুসলিমরা। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আবার একদল লোক ঢুকলো যারা বাঙালি। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে কোন সরকারের আমলেই এ নিয়ে আন্তরিকভাবে কাউকে কাজ করতে দেখিনি।
প্রশ্ন: সম্প্রতি একটি বিশ্ব র্যাংকিং-এ দেখা গেছে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় তালিকাতে নেই। এর কারণ এবং উত্তরণের উপায়?
উত্তর: আমি মনে করি এখনকার শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গ্রহণ করার ক্ষমতা কমেছে। এর পেছনে রয়েছে নানা কারণ। ছাত্রসংসদ নির্বাচনগুলো দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না। খেলাধুলা এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হবার সুযোগও সেরকম নেই। অর্থাৎ সুস্থ বিনোদনের অবকাশ নেই। ফলে অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। নষ্ট হচ্ছে সৃজনশীলতা। আজকাল শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে যায় বিসিএস এর বই পড়তে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন প্রাইভেটে। তাই শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বানাতে হবে। বাজেটের ২৫ ভাগ এবং জিডিপির কমপক্ষে ০২ ভাগ শিক্ষায় বরাদ্দ রাখতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শিক্ষার সাথে জীবিকার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হয়ে কাজ পাচ্ছে না। এ বিষয়টি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে।
প্রশ্ন: শিক্ষকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে আপনার অভিমত?
উত্তর: শিক্ষকদের যে কোন বিষয়ে নিজস্ব মতামত থাকবে। যে কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের সমর্থন থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা প্রত্যক্ষভাবে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হবেন না।
প্রশ্ন: দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?
উত্তর: দেশে এখন সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচন হচ্ছে না। মানুষের মতোই সংসদের দুটি পা থাকে। একটি সরকারি দল, অন্যটি বিরোধী দল। এখন দেশে কোন বিরোধী দল নেই। থাকলেও সেটি সরকারি দলেরই সাজানো বিরোধী দল যাকে অনেকে গৃহপালিত বিরোধী দলও বলে থাকেন।
বিরোধী দল না থাকার ফলে দানা বাঁধে বিক্ষোভের। সেক্ষেত্রে ডানদিকে দেখতে পাই উগ্রবাদী, জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী। বামদিকে কেউ নেই। আর শুধু জঙ্গিবাদীই নয়, রয়েছে হেফাজতের মতো গোষ্ঠী যাদের সরাসরি প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার।
এদেশে যা কখনো হয়নি, এখন তাই হচ্ছে। কৃষক তার কষ্টে উৎপাদিত ধান আগুনে পুড়াচ্ছে। প্রান্তিক কৃষক ভূমিহীন হয়ে মজুরে পরিণত হয়েছে। তাদের মেয়েরাই আবার গার্মেন্টস-এ কাজ করে নিগৃহীত হচ্ছে।
ধান এখন শিল্পের কাঁচামালে পরিণত হয়েছে। পাটের ক্ষেত্রেও তাই। কোন বুদ্ধিমান রাষ্ট্র তার কাঁচামাল রপ্তানি করে না। এখানে তাই হচ্ছে। ভারত আমাদের পাটের কাঁচামাল কিনে তা দিয়ে মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি করছে। পাকিস্তানি আমলে শুনতাম পাকিস্তান আমাদের পাট বিক্রি করে রাজধানী বানিয়েছে। সে কথাটিই এখন মনে পড়ছে।