লক্ষ্মীপুরে সুপারিতে হাজার কোটি টাকার ব্যবসার সম্ভাবনা
উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর প্রাচীণকাল থেকেই নারকেল-সুপারির জন্য বিখ্যাত। নারকেল-সুপারিতে ভরপুর আমাদের আবাস ভূমি প্রিয় লক্ষ্মীপুর এই প্রবাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও রয়েছে এই জেলায় সুপারিকে কেন্দ্র করে।
এ বছর লক্ষ্মীপুরের প্রধান অর্থকরী ফসল সুপারির ফলন তেমন ভালো না হলেও ভালো দামে বিক্রি করতে পেরে খুশি বাগান মালিকরা। করোনার ক্রান্তিকাল শেষে অর্থনৈতিক এই মন্দার সময়ে সুপারির ভালো দাম পেয়ে হাসি ফুটেছে বাগান মালিকদের মুখে।
লক্ষ্মীপুরের মাটি ও আবহাওয়া সুপারি উৎপাদনে উপযোগী। এ জনপদের এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে সুপারি গাছ নেই। এছাড়াও বিশাল-বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে অর্থকারী এ ফসলটির বাগান। আর এ ফসলকে ঘিরে এ অঞ্চলে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলায় চলতি বছর ৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত সুপারিতে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের সম্ভাবনা রয়েছে। সুপারি থেকে গেল বছর প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা আয় করেছেন লক্ষ্মীপুরের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। গাছ থেকে সুপারি পাড়া, বিক্রি ও সংরক্ষণের জন্য জেলার কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সুপারি উৎপাদনেও দেশসেরা লক্ষ্মীপুর।
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-রংপুর-খুলনা-দিনাজপুর, ময়মনসিংহেও পাঠানো হয় লক্ষ্মীপুরের সুপারি। সুপারিতে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি দেখছেন।
এবার একেকটি সুপারি দেড় থেকে দুই টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করছেন কৃষকরা। ব্যবসায়ীরাও লাভের আশায় সুপারি কিনে মজুত করছেন। তবে ব্যবসায়ীদের মাঝে লাভের চেয়ে লোকসানের আশঙ্কা বেশি। গেল বার লোকসান হওয়ায় এবারও তারা সেই শঙ্কায় ভুগছেন। জেলা শহরের উত্তর তেমুহনী ও সদর উপজেলার চররুহিতা ইউনিয়নের রসুলগঞ্জ বাজার এবং দালাবাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে এবার সারাদেশের মতো লক্ষ্মীপুররেও বৃষ্টি কম হয়েছে। এতে সুপারি আকার ছোট হয়েছে। উৎপাদনও কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। তবে সুপারির দাম কমেনি। স্বল্প সুপারিতে কৃষকরা প্রচুর লাভবান হচ্ছেন। সুপারি গাছ একবার রোপণ করলে তেমন কোনো পরিচর্যা ছাড়াই টানা ৩৫-৪০ বছর ফলন দেয়। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি আয় করা যায় সুপারি বিক্রি করে। সুপারি বাগানে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কিংবা রোগ-বালাই কম থাকায় এ অঞ্চলের কৃষকরা সুপারি চাষের দিকে বেশি আগ্রহী।
লক্ষ্মীপুরে সুপারির প্রায় ৭০ ভাগ নদীনালা, খালডোবা, পুকুর ও পানিভর্তি পাকা হাউজে ভিজিয়ে রাখেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। আর ৩০ ভাগ সুপারি দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ ছাড়াও রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। তবে জেলায় সুপারির প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র না থাকায় অনেক সময় কৃষকরা সুপারির ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে থেকে বঞ্চিত হন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো জেলা থেকেই তারা সুপারি সংগ্রহ করেন। একেকটি সুপারি দুই টাকা পর্যন্ত কিনতে হচ্ছে তাদের। আকার অনুযায়ী প্রতি পোণ (৮০টি) সুপারি ১৩০-১৮০ টাকা পর্যন্ত কিনেছেন তারা। এতে প্রতি কাউন (১৬ পোন) সুপারি ২৫০০-২৭০০ টাকা পড়েছে। গতবার তারা বেশি দামে সুপারি ক্রয় করলেও, লোকসানে বিক্রি করতে হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অক্টোবর থেকে জানুয়ারি সুপারির মৌসুম। তবে অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের শেষ সময় পর্যন্ত সুপারি সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ করা হয়। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, সদর, রামগঞ্জ, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সুপারি বিক্রি করতে দেখা যায় কৃষক ও গৃহস্থদের। আর সাপ্তাহিক হাটগুলো জমে ওঠে সুপারি ব্যবসায়ী ও কৃষকদের উপস্থিতিতে। গ্রামের গৃহবধূদেরকেও সুপারি বিক্রি করতে হাটে দেখা যায়।
সদর উপজেলার শাকচর ইউনিয়নের বাহার উদ্দিন বলেন, ‘বাপ-দাদারা বাগান রেখে গেছেন। সেই বাগানের নারকেল-সুপারি বিক্রি করেই আমাদের সংসার চলে। সুপারির ওপরই এই এলাকার অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুপারির বড় বাজারগুলোর মধ্যে রয়েছে রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ, খাসেরহাট, মোল্লারহাট, মিতালীবাজার, আলিয়া মাদরাসা মাঠ। রামগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ, পানপাড়া, কাঞ্চনপুর, দল্টা বাজার, সদর উপজেলার উত্তর তেমুহনী, দালাল বাজার, রসুলগঞ্জ, চন্দ্রগঞ্জ, মান্দারি, জকসিন, কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট, রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডারের সবচেয়ে বড় অস্থায়ী সুপারির বাজার বসে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা লক্ষ্মীপুরে এসে সুপারি কিনে নানা প্রান্তে নিয়ে যান। সেখান থেকে আবার বিদেশেও পাঠাচ্ছেন আড়তদাররা।’
সুপারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফয়েজ আহম্মেদ বলেন, ‘এ জেলার সুপারির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে গেল বছর বেশি দামে সুপারি কিনলেও, বিক্রিতে ভালো দাম পায়নি। এবারও সুপারির দাম বেশি। তবুও ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুপারি কিনে সংরক্ষণ করছি। পরবর্তীতে বিক্রির সময় দাম কমে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছি।’
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. জাকির হোসেন বলেন, উপকূলীয় জেলা হওয়ায় এখানে সুপারি চাষ বেশি হয়। সুপারিতে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুর জেলায় বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ রয়েছে। চলতি মৌসুমে সুপারির দাম বেশি পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি সুপারি ২ টাকা পর্যন্ত দিয়ে ব্যবসায়ীরা কিনছেন। উৎপাদন কম হলেও সুপারি বিক্রিতে এবার ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের সম্ভাবনা রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুপারি চাষ, পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের বিষয়ে কৃষি বিভাগ চাষীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আসছে।’