অর্থ আত্মসাতের পর থেকে পলাতক রয়েছেন ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের সাবেক চেয়ারম্যান মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ। তাকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন প্রতারণার শিকার প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা।
জানা গেছে, আদালতে দোষী প্রমাণিত হওয়ার তিনি যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান। অভিযোগ রয়েছে, সেখানে তিনি বাঙালি কমিউনিটিতে বীরত্বের সাথে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছেন। লন্ডন ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বিসিসিআইয়ের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। পলাতক আসামী হয়েও কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। এ বিষয়ে প্রবাসী বিনিয়োগকারী এম. মোহিদ আলী মিঠু বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক বিনিয়োগকারী ১২০ প্রবাসী অবিলম্বে তার শাস্তি দাবি করছেন। তারা মুসলেহ উদ্দিন আহমেদকে বিসিসিআই থেকে বহিস্কার করে সংগঠনটিকে কলঙ্কমুক্ত করার দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু তার কিছুই হচ্ছে না। অভিযোগকারীদের দাবি, মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় বিবিসিআইয়ের কিছু সদস্য অনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন, তাই তারা এখন মুসলেহকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে ঢাকা রিজেন্সি লিমিটেড নামে কোম্পানি গঠনে চুক্তিবদ্ধ হয় দীর্ঘ সময় ধরে লন্ডনে বসবাসরত ১২০ প্রবাসী। পরে ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড নামকরণ করা হয়। ১০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পে আরিফ মোতাহার, মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও কবির রেজার ৫২ কোটি টাকা এবং প্রবাসীরা শেয়ার হোল্ডার হিসেবে ৪৮ কোটি টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চুক্তি অনুসায়ী প্রতিটি শেয়ার ২৫ হাজার পাউন্ড বা ২৯ লাখ টাকা করে প্রদান করেন প্রবাসীরা। কোম্পানি গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ওই ৩ উদ্যোক্তা গ্রুপ ‘এ’ এবং প্রবাসী শেয়ারধারীদের গ্রুপ ‘বি’ ধরা হয় এবং উভয় গ্রুপের সমন্বয়ে পরিচালনা বোর্ড গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়। এই বিনিয়োগ করে অন্ধকারে রয়েছে লন্ডন প্রবাসী ১১৭ বাংলাদেশী।
ঢাকা রিজেন্সি হোটেল সূত্র মতে, বর্তমানে হোটেলটির চেয়ারম্যান হলেন উদ্যোক্তা পরিচালক মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান দিলকুশা বেগম (তিনি আরিফ মোতাহারের মা এবং কিছু দিন আগে মারা যান), ব্যবস্থাপনা পরিচালক কবির রেজা, পরিচালক নাজমা আরিফ (আরিফ মোতাহারের স্ত্রী), রোকেয়া খাতুন (কবির রেজার স্ত্রী), জেবুন নেসা (মুসলেহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী), আরিফ মোতাহার। তিনি এর আগে চেয়ারম্যান ও এমডি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাবস্থায় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দায়ের করা মামলায় জেল খেটেছেন আরিফ মোতাহার।
বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছিলেন, নতুন স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেডে বিনিয়োগ করে একটি চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা। বরং তাদের ন্যায্য শেয়ার ওই ৩ পরিচালকের স্ত্রী ও একজনের মায়ের নামে দেখিয়ে মোট ৭ জনের পারিবারিক বোর্ড বানানো হয়েছে। ওই ৩ জনের মধ্যেই ঘুরে ফিরে তারা চেয়ারম্যান, এমডি ও পরিচালক থাকছেন। প্রথম কয়েক বছরে এসব বিষয়ে আপত্তি তুললেও কোনো সুরাহা হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে শেয়ারধারীদের হয়রানি করা হয়েছে, শেয়ারধারী জেলও খেটেছেন। চাপের মুখে কয়েকজন শেয়ারধারীকে পরিচালক হিসেবে ভিজিডিং কার্ড দেয়া হলেও কার্যত কখনোই বোর্ডে রাখা হয়নি, তারা কোনো সভায় যোগ দিতে পারেননি। কোম্পানি প্রতিষ্ঠার শুরুর আগে পরিচালক বানানোসহ বছরে মুনাফার লোভ দেখানো হলেও হোটেলটি চালুর পর ন্যায্য শেয়ার দেয়া হয়নি। এখন তাদের মূল টাকা উঠানোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে বিনিয়োগকারীদের পক্ষে তখন পৃথক ২টি মামলা করেছেন এম. মোহিদ আলী মিঠু নামে প্রবাসী বিনিয়োগকারী। আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন ২৭ বিনিয়োগকারী। মামলা ৩টি হাইকোর্টের কোম্পানি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। মামলায় হোটেলটিতে অনিয়ম বন্ধে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নিয়োগসহ বিনিয়োগের সুরক্ষা চেয়েছেন তিনি। মামলা নং-৮১, ৮২/২০১৮ এ স্ট্যাটাসকে বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আর মামলা নং-৪৩, ১৪৯/২০১৮ স্থিতাবস্থা জারি করেছেন আদালত। অপর মামলাটি হলো-২৩৩, ২৩৫/২০১৪।
এম. মোহিদ আলী মিঠু তখন বলেছিলেন, ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড ১০০ কোটি টাকার কোম্পানি হলেও বর্তমানে সবকিছু মিলিয়ে ১ হাজার কোটি টাকার বাজারমূল্য রয়েছে, যা পুরোটাই ওই ৩ জন ভোগ-দখল করছে। প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ বা সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় না।
বিনিয়োগকৃত অর্থের সুরক্ষা চেয়ে দূতাবাসের মাধ্যমে সরকারকে চিঠি দিয়েছে বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ওই চিঠির অভিযোগ তদন্তসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদক ও পুলিশ প্রশাসন অনুরোধ করে, যা গত ২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসী বিনিয়োগকারীকে জানানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পুঁজিবাজার থেকে আইপিও’র মাধ্যমে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৬০ কোটি টাকা উত্তোলনের আবেদন করে ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড। আইপিও আবেদনে কোম্পানি ডিভিডেন্ট ফান্ডে ৮৪ কোটি টাকা রয়েছে উল্লেখ করা হয়। উত্তোলিত অর্থ কোম্পানি কক্সবাজারে একটি অত্যাধুনিক মানের হোটেল নির্মাণে ও ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের সংস্কারকরণে ও ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যয় করার কথা বলা হয়। বুক বিল্ডিং পদ্ধতি অবলম্বন করে আইপিওতে বাজারে আসতে কোম্পানিটি ‘রোড শো’ সম্পন্নও করে। কিন্তু ওই সময়ে শেয়ার নিয়ে জালিয়াতি অভিযোগ তুলে আইপিও বন্ধে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দেন কাজী ফয়সাল আহমেদ, কাজী কায়সার আহমেদ এবং কাজী জুবেল আহমেদ নামে ৩ বিনিয়োগকারী।
ওই চিঠিতে তারা বলেন, কোম্পানির পরিচালক আরিফ মোতাহার, কবির রেজা ও মোসলেহ আহমেদ নামের তিন উদ্যোক্তা হোটেল প্রতিষ্ঠাকালে বেশ কয়েকজন যুক্তরাজ্য প্রবাসীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তখন তাদের পরিচালক নিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের প্রথমে পরিচালক করা হয় এবং বিজনেস কার্ডও করে দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কৌশলে পর্ষদ থেকে বের করে দেয়া হয়। তারা উদ্যোক্তাদের অনিয়ম ও প্রতারণার শিকার হয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। পরে বিএসইসি তদন্ত শেষে আইপিও আবেদনটি বাতিল করে।