রাশিয়ার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সেনা সদর দপ্তর রোস্তভ এবং ভরোনেজ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করেছেন ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিন। রুশ সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাতের হুমকি দেওয়া এই নেতা আরও বলেছেন, তিনি ও তার ২৫ হাজার যোদ্ধা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান যুদ্ধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি ইয়েভজেনি প্রিগোশিন। একসময় ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে রুশ সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে যে ভাড়াটে সেনাদল, সেই ভাগনার গ্রুপের প্রধান তিনি। ভাগনার গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে যা জানা যায়, তা তুলে ধরা হলো-
প্রিগোশিন রাশিয়ার কারাগারগুলোতেও খুব পরিচিত এক মুখ। তিনি মূলত বিভিন্ন কারাগারে থাকা দণ্ডিত হাজার হাজার আসামিকে নিজের বাহিনীর সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অপরাধ কি ছিলো-তা কখনই বিবেচনায় নিতেন না তিনি।
ইউক্রেন যুদ্ধে ভাগনার বাহিনী রাশিয়ার হয়ে লড়াই করেছে। কিন্তু ইয়েভজেনি প্রিগোশিন কয়েক মাস ধরে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সামরিক প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বারবার এই দুজনের অযোগ্যতা ও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ভাগনারকে কম অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ করেন। এ নিয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার টানাপোড়েন শুরু হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধের আগে প্রিগোশিনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ এবং আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব আরও বাড়াতে তৎপরতা চালানোর অভিযোগও ছিল।
৬২ বছর বয়সী প্রিগোশিনের জন্ম রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে। এই এই সেন্ট পিটার্সবার্গেই জন্ম রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্কও রয়েছে। মূলত ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহের মধ্য দিয়ে ‘পুতিনের পাচক’ পরিচিত পান প্রিগোশিন।
প্রিগোশিন ১৮ বছর বয়সে ১৯৭৯ সালে চুরির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে প্রথমবারের মতো কারাভোগ করেন। এর ঠিক দুই বছর পর ডাকাতির দায়ে তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনি ৯ বছর কারাভোগ করেন। কারাভোগ শেষে ব্যবসা শুরু করেন প্রিগোশিন। তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে হট ডগ বিক্রি করা শুরু করেন। পরে ধীরে ধীরে তিনি বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁর মালিক হয়ে যান। পিটার্সবার্গে প্রিগোশিনের রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে একটির নাম ছিল নিউ আইল্যান্ড। ভাসমান এ রেস্তোরাঁটি নেভা নদীতে ভেসে বেড়াত। পুতিনের বেশ পছন্দের রেস্তোরাঁ ছিল এটি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পুতিন তার বিদেশি অতিথিদের এই ভাসমান রেস্তোরাঁয় আনতেন।
এভাবে ধীরে ধীরে পুতিনের সঙ্গে প্রিগোশিনের ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। এর কয়েক বছর পর প্রিগ্রোশিনের মালিকানাধীন একটি ক্যাটারিং কোম্পানি কনকর্ড ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহ করার দায়িত্ব পায়। এরপর সামরিক বাহিনী ও সরকারি স্কুলেও খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পায় প্রিগোশিনের কনকর্ড।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালায় রাশিয়া। তখন ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। সে সময় এমন খবর প্রকাশিত হয় যে, প্রিগোশিন কোনো সাধারণ ব্যবসায়ী নন। প্রথম জানা যায়, একটি ছদ্মবেশী বেসরকারি সামরিক প্রতিষ্ঠান তার সঙ্গে যুক্ত এবং ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে এর সেনারা লড়ছে।
তবে শুধু ইউক্রেন নয়, বিশ্বজুড়ে নিজেদের আধিপত্য বাড়াতে ক্রেমলিন ভাগনার গ্রুপকে ব্যবহার করছে। আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে সক্রিয় ভাগনার। ক্রেমলিনের ‘অ্যাজেন্ডা’ বাস্তবায়নই এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারকে সহযোগিতা থেকে শুরু করে মালিতে ফ্রান্সের প্রভাব ঠেকানো পর্যন্ত যা বিস্তৃত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাড়াটে এই সশস্ত্র সেনাদল ক্রেমলিনের নির্দেশে নিষ্ঠুর ও পাশবিক অভিযান চালানোর জন্য বিশ্বজুড়ে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে সিরিয়ায় এক বন্দীকে হাতুড়ি দিয়ে নির্যাতন চালানোর পর তার শিরশ্ছেদ করে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে এই ভাগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রিগোশিন স্বীকার করেন, ২০১৪ সালে তিনিই ভাড়াটে এই সেনাদল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ভাগনারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউর। তবে রাশিয়ার আইন অনুযায়ী অবৈধ হলেও দেশটিতে কার্যক্রম চালাতে বাধা দেওয়া হয় না।
প্রিগোশিনের নেতৃত্ব এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যার কাজ ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ক্রেমলিনের মতাদর্শিক অবস্থানের প্রচার করা। এতে নেতৃত্ব দেয় পিটার্সবার্গের ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি (আইআরএ)। সংস্থাটির বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগের বিষয়টির প্রমাণ পাওয়ার পর আইআরএ ও প্রিগোশিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনে অপপ্রচার চালানোর কাজে নিয়োজিত আছে আইআরএ সংস্থাটি। শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ইউক্রেন নয় যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের মতো দেশেও প্রিগোশিনের ‘সাইবার সেনারা’ বিভিন্ন অপপ্রচার চালান বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রিগোশিন স্বীকার করেন যে, তিনিই আইআরএ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার নির্দেশেই এটি পরিচালিত হচ্ছে। সূত্র: রয়টার্স এবং বিবিসি