ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশগুলোর সহযোগিতা সংস্থা- ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরএ) এর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য (২৩-২৪ নভেম্বর) দুই দিনের সফরে ঢাকা আসছেন। এটা কেবল তার-ই প্রথম বাংলাদেশ সফর নয়, বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে এর আগে কোনো রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসেন নি। ল্যাভরভ আইওআরএ’র বৈঠক ছাড়াও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। অনেক দিক থেকেই তার প্রথম সফর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ যতোটা না বড় রাজনীতিবিদ, তারচেয়েও বেশি একজন উজ্জ্বল কূটনীতিক এবং বেসামরিক আমলা। তিনি দীর্ঘ ১০ বছর জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সেই ২০০৪ সাল থেকে। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ঢাকা সফর করেননি। একারণে ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সফরটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রস্তাবিত সফরটি নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে বহুদিন ধরেই জল্পনা চলছিল। এখন সেটি সফলতার মুখ দেখছে।
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ‘পাকিস্তান টুডে’তে প্রকাশিত এক নিবন্ধে মেহজাবিন ভানু এমন মন্তব্য করে লিখেছেনঃ এর আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ল্যাভরভকে আইওআরএ সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আইওআরএ’র বর্তমান চেয়ারম্যান বাংলাদেশ আশা করছে এতে এক ডজনেরও বেশি মন্ত্রী যোগদান করবেন। রাশিয়াসহ অনেকেই আমন্ত্রণ পেয়ে সম্মেলনটিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন ইস্যু ছাড়াও ল্যাভরভ ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশকে রাশিয়ার পাশে চাইবেন। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া অনেক চাপের মধ্যে রয়েছে। জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ একের পর এক প্রস্তাব আনছে। রাশিয়া বড় ব্যবধানে এই প্রস্তাবগুলোতে হারছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশ সফর করে রাশিয়া বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
সোভিয়েত আমল থেকেই বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল। সোভিয়েত-পরবর্তী সময়েও রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব অব্যাহত ছিল। এভাবে রাশিয়া শুরু থেকেই বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু। ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি রাশিয়া-বাংলাদেশ নিজেদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উল্লেখ করেছেন যে, মস্কো ও ঢাকার মধ্যে সম্পর্ক ক্রমাগতভাবে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার চেতনায় বিকশিত হচ্ছে।
এর কয়েক মাস পর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য রাশিয়ার ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে এর মাধ্যমে মস্কোকে সংযত করা যায়নি, বরং বাংলাদেশের মানুষসহ সারা বিশ্বের মানুষ এতে ভুগছে। তিনিই প্রথম সরকারপ্রধান, যিনি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেন। এটি বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক বন্ধনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
‘রাশিয়া অনেক কারণেই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ’ মন্তব্য করে নিবন্ধে লেখা হয়েছেঃ এগুলোর মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহযোগিতা, গম ও সার সহ অন্যান্য পণ্য আমদানি এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠা।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান বের করতে রাশিয়াকে কাছে চায় বাংলাদেশ। গত মাসে, মোমেন কাজাখস্তানে ল্যাভরভের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো সমর্থনের ওপর জোর দেন। বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের বিরোধমুক্ত সমাধানে পৌঁছাতে মিয়ানমারের সঙ্গে রাশিয়া ত্রিপক্ষীয় প্রক্রিয়া শুরু করুক। তবে, এর জবাবে ল্যাভরভ সরাসরি কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। মোমেন-ল্যাভরভ বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হবে। এই সফরে কোনো নতুন চুক্তি না হলেও দুই দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে।
এটা উল্লেখ্য যে, বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় নিজের জ্বালানি, খাদ্য ও সারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের রাশিয়ার সহায়তা প্রয়োজন, কারণ বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশকে এসব নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই টিকে থাকতে হবে। বিশ্বজুড়ে চলমান সংকটের মধ্যে রাশিয়া থেকে খাদ্য ও জ্বালানি আমদানি করতে চায় বাংলাদেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত, চীনসহ কয়েকটি দেশ রাশিয়া থেকে ছাড়ে তেল কিনছে। গত মে মাসে রাশিয়াও বাংলাদেশকে অপরিশোধিত তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল। ল্যাভরভের আসন্ন সফরে বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছে নিজের দাবিগুলো আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারবে।
অন্যদিকে, রাশিয়ার বাজারে পোশাকসহ বাংলাদেশে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নানা জটিলতার কারণে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ও অন্যান্য পণ্য অন্য দেশের মাধ্যমে রাশিয়ায় রপ্তানি করতে বাধ্য হচ্ছে। উভয় দেশের ব্যবসায়িক স্বার্থে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করা জরুরি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়ায় ৬৬৫.৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, আর আমদানি করেছে ৪৬৬.৭০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
তবে, দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য কাজেও বাংলাদেশ রাশিয়াকে অংশীদার করেছে। যুদ্ধের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়ার অর্থায়ন কমে গেছে। আবার এ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় অর্থ পাঠানোও বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে অর্থ বিনিময় স্বাভাবিক করতে দুই দেশ কাজ করছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ল্যাভরভের আনুষ্ঠানিক সফরে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি খাতে সহযোগিতার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখবে।
বাংলাদেশ ও রাশিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধিতে আছে। তবে, দুই পক্ষেরই আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ-রাশিয়া বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও কারিগরি সহযোগিতা বিষয়ক আন্তঃসরকার কমিশনের বৈঠক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আরও সম্প্রসারণের বাধাসমূহ দূর করবে। আশা করা যায় যে, বাংলাদেশ-রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ ও দৃঢ় সম্পর্ক ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।