বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় লোকসানের কথা বলে প্রথমে আখ মাড়াই এবং পরে বন্ধ ঘোষণা করা হয় রংপুর চিনিকল। অথচ এই এলাকায় কৃষিভিত্তিক একমাত্র ভারী শিল্পকারখানা হচ্ছে এ চিনিকল। সেই রংপুর চিনিকল আবার চালু হবে, এই খবরে এলাকায় বইছে খুশির বন্যা। নতুন করে স্বপ্ন বুনছেন শ্রমিকসহ আখচাষিরা।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে অবস্থিত রংপুর চিনিকল লোকসান কমাতে এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার কথা বলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫টির মধ্যে যে ছয়টি চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয়, তার মধ্যে একটি এটি। গত ১৫ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে মাড়াই স্থগিতকৃত ছয়টি চিনিকলের মাড়াই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের সরকারি সিদ্ধান্তের খবর ছড়িয়ে পড়লে আখচাষিসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে বইতে শুরু করে আনন্দের বন্যা।
রংপুর চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষিসহ এলাকার লোকজন অভিযোগ করেন, ২০২০-২১ বার্ষিক আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও সর্বোচ্চ মাড়াইক্ষমতা ও বিপুল পরিমাণ জমিতে দণ্ডায়মান আখ রেখে একেবারে শেষ মুহূর্তে মাড়াই বন্ধ করা হয়। সেই সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ আখচাষি ও শ্রমিক-কর্মচারীরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার শ্রমিক আন্দোলন ও চাষিদের করুণ আকুতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রাখে।
শ্রমিক-চাষিরা বলেন, তখন আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিদের উদ্দেশ্যে দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল, আধুনিকায়নের মাধ্যমে খুব দ্রুতই আবার চালু করা হবে এই চিনিকলসহ সব ক’টি চিনিকল। কিন্তু প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষি ছাড়াও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা অর্জনের মাধ্যম এই রংপুর চিনিকলটি চালু হয়নি গত পাঁচ বছরেও। বরং এ চিনিকলের স্থায়ী চাকরিজীবীদের একাংশ, গাড়ি, যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে চলমান অন্য চিনিকলে।
কাজ হারানো ‘কাজ নাই, মজুরি নাই’ চুক্তিভিত্তিক প্রায় পাঁচশো শ্রমিক এখন পেটের দায়ে ভ্যান-রিকশা চালনাসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অন্যদিকে চালু রাখা পার্শ্ববর্তী চিনিকলের চাইতে অধিক মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন ও অধিক পরিমাণ আখ উৎপাদিত হলেও রহস্যজনক কারণে এ কলটি বন্ধ করায় বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এলাকার হাজার হাজার আখচাষিসহ সাধারণ মানুষ।
চিনিকল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে তৎকালীন এরশাদ সরকারের শাসনামলে আধুনিকায়নের নামে কর্মকর্তাদের জন্য দামি গাড়ি-বাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও কারখানার কিছু সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার আওতাধীন চিনিকলগুলোকে। এসব ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনিকলগুলোর। রংপুর চিনিকলের বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত লোকসানের প্রধান কারণ বিশ্ব ব্যাংকের এই ঋণ বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
গত চার বছর বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের কারখানার চত্বর ভরে গেছে জঙ্গলে। খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলোও ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যও একই রকম। কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতিতে এখন মরিচার রাজত্ব। থমকে আছে জীবিকার চাকাগুলো। আখচাষি আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমাবেশের চিরচেনা দৃশ্য আর নেই। হাজারো মানুষের একসময়ের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ ও মিলে আখ সরবরাহের জন্য শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি এখন গো-চারণভূমি।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহুকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণকাজ। ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছর পর শেষ হয় মিলটির নির্মাণ কাজ। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন শুরু হয় মিলটিতে। পশ্চিম জার্মানীর বাকাউ-উলফ নামের একটি কোম্পানি থেকে আনা মেশিনে ৩৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠে মিলের কারখানা ও কার্যালয়। ১৯৭২ সালে রংপুর চিনিকলসহ সব চিনিকলকে রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এ চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। পুকুরসহ রেলওয়ে সাইডিংয়ের জায়গা ৮ একর, সাড়ে ১৪ একর জায়গায় গড়ে ওঠে ৫০টি ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র এবং ৮টি সাবজোন। এছাড়াও মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮৩২ একর। ১৯৫৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ৯৮৫ দিনের মধ্যে ৫ হাজার ৭৩৯ দিন ঘোরে মিলের চাকা। এ সময়কালে ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি।
রংপুর চিনিকলের ছিল নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এখানকার পাওয়ার হাউজে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো। চিনিকলের আখ পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব রেলপথ। সেই রেলপথে নিজস্ব রেলের ইঞ্জিন ও মালবাহী বগি দিয়ে পরিবহন করা হতো আখ, চিনি, চিটাগুড় ও জ্বালানিসহ নানা দ্রব্য।
রংপুর চিনিকলকে ঘিরে জাঁকজমক ছিল মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশন। বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে মহিমাগঞ্জ। শিক্ষার প্রসারেও অন্যতম ভূমিকা রাখে রংপুর চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয়। সবকিছু মিলিয়ে চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষিসহ অসংখ্য মানুষের আয়-রোজগারের পথ সৃষ্টি করেছিল রংপুর চিনিকল।
রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান সুজা বলেন, দেশের কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে বিগত স্বৈরাচারী সরকার রাষ্ট্রায়াত্ত চিনিশিল্প বন্ধ করে দেওয়ার গভীর চক্রান্ত করেছিল। চিনিকলটি বন্ধ হয়ে থাকায় এই জনপদের সকল স্তরে অন্ধকার নেমে এসেছে। বর্তমান সরকার অসাধু সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের এই জাল ছিন্ন করে পুনরায় চিনিকলটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে চালু করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা খুবই বাস্তবসম্মত। আমরা একে স্বাগত জানাই।
মিলস গেট সাবজোনের আখচাষি ফেরদৌস আলম অভিযোগ করে বলেন, রংপুর চিনিকলের চাইতে অনেক কম মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন জয়পুরহাট চিনিকলের আখ জোন এলাকায় আখও উৎপাদন হয় কয়েক গুণ কম। তারপরও ওই মিলটি চালু রেখে ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের রংপুর চিনিকলের আখ এবং ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের শ্যামপুর চিনিকলের আখ জয়পুরহাটে পরিবহন করতে অতিরিক্ত ব্যয় করার মাধ্যমে এ শিল্পটি চিরতরে বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। বন্ধ চিনিকলগুলো পুনরায় চালুর সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ইনচার্জ) মাসুমা আকতার জাহান বলেন, রংপুর চিনিকলসহ মাড়াই স্থগিতকৃত ছয়টি চিনিকল পুনরায় চালুর বিষয়টি আমিও শুনেছি। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এই চিনিকলটি চালু হলে অবশ্যই লাভজনক অবস্থায় উন্নীত হবে। কারণ এখানকার মাটি ও পরিবেশ আখচাষের জন্য খুবই উপযোগী।