মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে এরই মধ্যে ২৯০টি বগলদাবা করেছেন তিনি। আরও দুই-তিনটি রাজ্যের ফল ঘোষণা বাকি।
এই জয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস গড়লেন বাইডেন। এর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পপুলার ভোট পাওয়ার ইতিহাসও সৃষ্টি করেন ৭৭ বছর বয়সী এ ডেমোক্র্যাট।
তিনি পপুলার ভোট পেয়েছেন (ফল ঘোষণা না হওয়া তিন রাজ্য বাদে) ৭ কোটি ৪৮ লাখ ৭২ হাজার ৫৭০টি। সে পর্যন্ত ট্রাম্প পেয়েছেন ৭ কোটি ছয় লাখ এক হাজার ৯৬৮ ভোট।
তবে বিবিসি বলছে, জো বাইডেন মোট পপুলার ভোট পেয়েছেন ৭ কোটি ৪৪ লাখ ৭৮ হাজার ৫৩৩ ভোট। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ৭ কোটি ৩ লাখ ৩০ হাজার ২১০ ভোট। এতে দেখা যায়, ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেন ৪১ লাখ ৪৮ হাজার ৩২৩ ভোট বেশি পেয়েছেন। এখনও ছয় রাজ্যের ভোট গণনা চলছে।
ফল ঘোষণা নিয়ে চার দিন ধরে রুদ্ধশ্বাস সময় কাটছিল মার্কিনিদের। বিশ্বও তাকিয়ে ছিল এর দিকে। ট্রাম্পের নানা অভিযোগ ও তার দল রিপাবলিকানদের নানা কার্যকলাপে বাড়ছিল উত্তেজনাও।
অবশেষে সেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার অবসান ঘটল। ট্রাম্প ফল না মেনে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পর পর দুবার এক ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট হওয়ার চল বহুদিনের (দুই-চারটি ব্যতিক্রম বাদে)। তবে এবার সেই রেওয়াজ ভেঙে জো বাইডেন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
তার এই অবিস্মরণীয় জয়ের নেপথ্যে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে সেই কারণগুলো উঠে এসেছে।
করোনাভাইরাস
ট্রাম্পের পরাজয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে– বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসকে। কোভিড ১৯-এ দেশটিতে আজ পর্যন্ত ২ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এক কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত। এই মহামারীর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে বলে মার্কিনিরা মনে করেন। এমনকি ট্রাম্প এই ভাইরাসকে শুরু থেকেই গুরুত্বই দেননি। তিনি এটিকে সাধারণ ফ্লু হিসেবে আখ্যা দেন।
এমনকি উইসকনসিনে নির্বাচনী র্যালিতে কোভিড-১৯ সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন– ‘ফেক নিউজে সব কিছুই কোভিড, কোভিড, কোভিড, কোভিড।’
মহামারী সম্পর্কে তার যে অবস্থান, যেভাবে তিনি বিষয়টি সামলেছেন সেটি শেষ পর্যন্ত তার বিপক্ষেই গেছে।
অন্যদিকে জো বাইডেন ক্যাম্প কোভিড ইস্যুতে যে অবস্থান নিয়েছিলেন সেটি তাকে এগিয়ে দিচ্ছে এমনটিই দেখা গিয়েছিল গত মাসে করা এক জনমত জরিপে।
ট্রাম্পের ভুল প্রচার
বৈশ্বিক মহামারীতে যে ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা কৌশলকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
মহামারী ও ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়শই যেভাবে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছেন, বিজ্ঞানকে প্রশ্ন করেছেন, একদম হুট করে এলোমেলোভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পক্ষপাতমূলক আচরণ এই বিষয়গুলো জো বাইডেন ক্যাম্প সফলভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে কাজে লাগিয়েছে।
গ্রীষ্মকালে করা আরেক জরিপে দেখা গিয়েছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের রেটিং ৩৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে করোনা ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে বাইডেন শিবিরের প্রচার তাদের এগিয়ে দিয়েছে।
বাইডেনের ধীরগতির প্রচার
বাইডেনের চতুন প্রচার কৌশলই তাকে নির্বাচনে এগিয়ে দিয়েছে। এর আগে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন তার দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে ভুল বক্তব্য ও অসমীচীন কাজের জন্য বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন।
যেসব ভুল তাকে প্রায়শই বিপদগ্রস্ত করেছে। আগের তিনটি নির্বাচনে ভুল প্রচার কৌশলে ধরাশায়ী হন বাইডেন। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে এমন ভুল তার হারের কারণ ছিল। জো বাইডেন তার ভুল বক্তব্যের জন্য বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন। ২০০৭ সালে আবার যখন তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন সেবার তার তেমন একটা সম্ভাবনাই ছিল না।
কিন্তু তৃতীয়বার যখন ওভাল অফিসের জন্য লড়েছেন, তখন তিনি বক্তব্য দেয়ার সময় যথেষ্ট কম হোঁচট খেয়েছেন।
এর একটি বড় কারণ হচ্ছে– ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে তার লাগামহীন অসামঞ্জস্যপূর্ণ নানা বক্তব্যের কারণে নিয়মিত খবরের উৎস ছিলেন।
আর তা ছাড়া বৈশ্বিক মহামারী, অর্থনৈতিক সংকট, জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পর বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময়ের সহিংস বিক্ষোভ– এ রকম জাতীয় পর্যায়ের বড় ঘটনার দিকে সমাজের মানুষের মনোযোগ বেশি ছিল।
এর বাইরে এবার বাইডেন ক্যাম্প খুব হিসাব কষে এগিয়েছে। বাইডেনকে যতটা সম্ভব কম জনসম্মুখে আসতে দেখা গেছে।
প্রচারণার গতি এমন ছিল, যাতে প্রার্থী ক্লান্তি থেকে অসাবধানতাবশত কিছু না করে বসেন। বাইডেন ক্যাম্প বরং ট্রাম্পকে তার মুখ খোলার সুযোগ দিয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত কাজে লেগেছে।
আর যেই হোক ট্রাম্প নয়
নির্বাচনের দিনটির এক সপ্তাহ আগে জো বাইডেন ক্যাম্প তাদের সর্বশেষ টেলিভিশন বিজ্ঞাপন প্রচার করে।
গত বছর জো বাইডেন প্রার্থী হিসেবে যখন মনোনীত হন এবং যেদিন তার প্রচার শুরু করেন সেই সময়কার বক্তব্যের সঙ্গে এই বিজ্ঞাপনের বক্তব্যে বেশ লক্ষণীয় সাদৃশ্য ছিল। লাগামহীন অসামঞ্জস্যপূর্ণ নানা বক্তব্যের কারণে নিয়মিত খবরের উৎস ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই নির্বাচনকে উল্লেখ করা হয় ‘যুক্তরাষ্ট্রের আত্মরক্ষার যুদ্ধ।’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরকে বিভক্তি ও বিশৃঙ্খলার সময়কাল বলে উল্লেখ করা হয়।
মার্কিনিরা শান্ত ও অবিচল একজন নেতা চেয়েছেন। ভোটারদের অনেকেই বলেছেন, তারা ব্যক্তি হিসেবে ট্রাম্পের আচরণে রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ।
বাইডেন ক্যাম্প ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে, এই নির্বাচন যেন দুই প্রার্থীর মধ্যে যোগ্য একজনকে বেছে নেয়ার নির্বাচন নয়।
মধ্যপন্থী অবস্থান
ডেমোক্র্যাট দল থেকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়ার লড়াইয়ে জো বাইডেনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বার্নি স্যান্ডার্স, যিনি বামপন্থী হিসেবে পরিচিত। আরেকজন ছিলেন এলিজাবেথ ওয়ারেন। যার ক্যাম্পেইনে বেশ ভালো অর্থের জোগান ছিল।
এই দুজনের যে কোনো সভায় রক গানের কনসার্টের মতো মানুষ জড়ো হতো। কিন্তু জো বাইডেন উদারপন্থীদের চাপের মুখেও মধ্যপন্থী অবস্থান বজায় রেখেছেন।
তিনি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, বিনামূল্যে কলেজ শিক্ষা ও ধনীদের জন্য বেশি করারোপ করার নীতিগুলোতে সমর্থন দেননি।
ফলে তিনি মধ্যপন্থী ও অসন্তুষ্ট রিপাবলিকানদের কাছে টানতে পেরেছেন। কমলা হ্যারিসকে রানিং মেট হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তে এটি প্রকাশ পেয়েছে।
বেশি অর্থ, কম সমস্যা
এই বছরের শুরুতে জো বাইডেনের প্রচার তহবিল প্রায় শূন্য ছিল বলা যায়। ট্রাম্পের বিপক্ষে তার সীমাবদ্ধতা ছিল এটি। ট্রাম্পের প্রচার ছিল শতকোটি ডলারের বিষয়।
কিন্তু এপ্রিল মাসে এসে তহবিল গঠনে জোরালোভাবে লেগে পড়ে বাইডেন ক্যাম্প। অন্যদিকে ট্রাম্পের পদ্ধতি হচ্ছে বাড়াবাড়ি অপচয়।
নির্বাচনী প্রচারের শেষের দিকে এসে ট্রাম্প ক্যাম্পের চেয়ে বড় তহবিল গড়েছিলেন বাইডেন।
অক্টোবর মাসে ট্রাম্পের চেয়ে ১৪৪ মিলিয়ন ডলার বেশি ছিল বাইডেনের তহবিলে, যা ব্যবহার করে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে রিপাবলিকানদের বড় ধাক্কা দেন বাইডেন।
ভোটার আকর্ষণ করতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গণমাধ্যমে বার্তা দিয়ে গেছেন জো বাইডেন।
ওবামাকে পাশে পাওয়া
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামাকে পাশে পেয়েছিলেন জো বাইডেন। যেটি তাকে নির্বাচনে বেশ এগিয়ে রেখেছে। ওবামা বাইডেনের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেন। তিনি ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হন যে, যুক্তরাষ্ট্রে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বাইডেনের মতো নেতা দরকার।
বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় পেনসিলভানিয়ার ফল ঘোষণা করা হলে সঙ্গে সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন বাইডেন সমর্থকরা।
তারা রাস্তায় নেমে এসে নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। অভিনন্দন জানান নতুন রাষ্ট্রপ্রধানকে। বিশ্বনেতারাও অভিনন্দন জানিয়েছেন বাইডেনকে।
এ ফল আসার পর একই টুইটে আমেরিকাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন জো বাইডেন।
তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই প্রতিশ্রুতি আমি আপনাদের দিচ্ছি, আপনি আমাকে ভোট দিন বা না দিন, আমি হব সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট। আমার ওপর যে আস্থা আপনারা রেখেছেন, তার প্রতিদান আমি দেব।’
তবে এ ফল মানতে পারেননি ট্রাম্প ও তার সমর্থকরা। পরাজয় মানবেন না ঘোষণা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, তাকে (বাইডেন) মিথ্যা বিজয়ী হিসেবে দেখানো হচ্ছে।