যেভাবে ভ্রমণ ইসলামে ইবাদত হয়ে যায়!

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা

ইসলামে ভ্রমণ একটি উৎসাহিত বিষয়, বরং আল্লাহর সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখে ঈমানের দৃঢ়তা সৃষ্টি করতে এবং অবিশ্বাসীদের করুণ পরিণতি দেখে শিক্ষা গ্রহণের জন্য সফর অন্যতম ইবাদতও বটে। এ ছাড়া নানা প্রয়োজনে ভ্রমণ করতে হয়। মানবজীবনের সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভ্রমণকে নিরাপদ করতে ইসলামের বেশ কিছু নির্দেশনা আছে।

সেগুলোর প্রতিপালন ভ্রমণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে এবং ভ্রমণ একটি ইবাদত হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে।
অভিজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ : সবাই সব বিষয়ে অভিজ্ঞ হয় না। যারা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ সে বিষয়ে তাদের পরামর্শ নিলে সফল হওয়া সহজ হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড়দের অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ভুলের সম্ভাবনা কমে যায় এবং সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা সহজ হয়। কাজেই ভ্রমণের আগে গন্তব্যস্থল ও যাতায়াত বিষয়ে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে ভ্রমণ আরামদায়ক হবে—এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা না জানো, তাহলে যারা জানে তাদের জিজ্ঞেস করো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৩)

নামাজ পড়ে বের হওয়া : ভ্রমণের সিদ্ধান্ত হলে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে বের হওয়া অতি উত্তম।

মুতইম ইবন মিকদাম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সফরকারী তার পরিবারের জন্য দুই রাকাত নামাজের চেয়ে ভালো কিছু রেখে যায় না। (মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবা, হাদিস : ৪৮৭৯)

একা ভ্রমণ এড়িয়ে চলা : যতটা সম্ভব একা একা ভ্রমণ পরিহার করা উচিত। একা একা ভ্রমণে নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়। কাজেই সফরসঙ্গী বা দল নিয়ে ভ্রমণ করা ভালো। ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি একা সফরে কী ক্ষতি আছে লোকেরা তা জানত, যা আমি জানি, তবে কোনো আরোহী রাতে একাকী সফর করত না।

(বুখারি, হাদিস : ২৯৯৮)
আমির নির্বাচন করা : সব কিছুতে একাধিক ব্যক্তির সমন্বয় হলে একজনকে আমির বানিয়ে নেওয়া উচিত। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে চলার মাধ্যমে ভ্রমণকে আরামদায়ক করা সহজ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সফরে তোমরা যদি তিনজন হও, একজনকে আমির নিযুক্ত করো। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬০৯)

সফরের জিকির ও দোয়া পড়া : বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত ভ্রমণকালে বিভিন্ন জিকির ও দোয়া আছে। এগুলোর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সহায়তা কামনা করা হয় ও সফলতার প্রার্থনা করা হয়। যেমন—

১. বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলা— ‘বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওউতা ইল্লা বিল্লাহ।’ অর্থ : আল্লাহর নামে বের হলাম। আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো সামর্থ্য ও শক্তি নেই। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৯৫; তিরমিজি, হাদিস : ৩৪২৬)

২. যানবাহনে আরোহণের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া। যানবাহনে বসার পর তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ পড়া। এরপর বলা ‘সুবহানাল্লাজি সাখখারালানা হা-যা ওয়া-মা-কুন্না লাহু মুকরিনিন, ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুন কালিবুন।’ অর্থ : আল্লাহর নামে শুরু করছি, যিনি অত্যন্ত দয়ালু ও অশেষ করুণাময়। তিনি পবিত্র ওই সত্তা, যিনি বাহনকে আমার অধীন করে দিয়েছেন। আমাদের কাছে তাকে আয়ত্তে আনার ক্ষমতা ছিল না। অবশ্যই আমরা আমাদের প্রতিপালকের দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬০২; তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৪৬)

৩. সফরের দোয়া—‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফি সাফরিনা হা-জাল বিররা ওয়াত তাকওয়া, ওয়া মিনাল আমালি মা তার-দ্বা আল্লাহুম্মা হাউয়িন আলাইনা সাফারনা হা-যা, ওয়াতওই আন্না বুদাহু, আল্লাহুম্মা আনতাস্-সাহিবু ফিস্-সাফরি, ওয়াল খালিফাতু ফিল আহলি ওয়াল মাল। আল্লাহুম্মা ইন্না নাউজুবিকা মিন ওয়া-ছা-ইস সাফারি ওয়া-কাআবাতিল মানজারি, ওয়া সুইল মুনকালাবি ফিল আহলি ওয়াল মাল।’

অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের এই সফর সহজ করে দাও। রাস্তার দূরত্ব কমিয়ে দাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সফরের সঙ্গী এবং আমাদের পরিবারের কাছে তুমি আমাদের স্থলাভিষিক্ত। হে আল্লাহ! তোমার কাছে সফরের কষ্ট-ক্লান্তি ও ভয়ানক দৃশ্য দেখা থেকে এবং পরিবার, সম্পদ-বিত্ত ও অধীনস্তদের কাছে খারাপ অবস্থায় ফেরত আসা থেকে তোমার কাছে রক্ষা চাই। (মুসলিম, হাদিস : ১৩৪২)

৪. নৌকা বা জাহাজে ভ্রমণের দোয়া—‘বিসমিল্লাহি মাজরিহা ওয়া মুরসা-হা, ইন্না রাব্বি লা গাফুরুর রহিম।’

অর্থ : ‘তোমরা এতে আরোহণ করো। আল্লাহর নামেই এর গতি ও স্থিতি। আমার পালনকর্তা অতি ক্ষমাপরায়ণ, মেহেরবান।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৪১)

৫. ভ্রমণের মাঝপথে কোথাও অবস্থান করতে দোয়া—‘আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তা-ম্মাতি মিন শাররি মা খালাক’। অর্থ : আমি আল্লাহ্র পূর্ণ কালিমাসমূহের অসিলায় তাঁর সব সৃষ্ট জীবের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই। (মুসলিম, হাদিস : ২৭০৮)

ঝুঁকিপূর্ণ বাহন পরিহার করা : ঝুঁকিপূর্ণ বাহন, অরক্ষিত এলাকা এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে হবে। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সাগরে ভ্রমণ করতে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং উত্তাল সাগরে ভ্রমণ করতে বারণ করেছেন। আবু ইমরান আল-জাওনি (রা.) থেকে বর্ণিত, জনৈক সাহাবি বলেন, আমরা পারস্য অভিমুখে যুদ্ধ করেছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি চারদিক ঘেরা নেই—এমন ছাদে রাত যাপন করা অবস্থায় নিচে পড়ে মারা গেলে কারোর ওপর তার কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না। তেমনি যে ব্যক্তি উত্তাল সাগরে ভ্রমণ করে মারা গেল কারো ওপর তারও কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২০৭৪৮)

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হজ, ওমরাহকারী বা আল্লাহর পথে যুদ্ধকারী ব্যতীত কেউ যেন সমুদ্রে ভ্রমণ না করে। কেননা সাগরের নিচে আগুন আর আগুনের নিচে সাগর আছে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৮৩)

ভ্রমণ শেষে কৃতজ্ঞতা আদায় ও দোয়া পাঠ : ভ্রমণ শেষে নিরাপদে বাড়িতে ফিরে আসতে পারা মহান আল্লাহর অন্যতম অনুগ্রহ। আল্লাহর এই অনুগ্রহ পেয়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা বান্দার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। প্রশান্ত হৃদয়ে, বিনয়-নম্রতার সঙ্গে এবং তাঁর নির্দেশিত পন্থা অনুসরণ করে কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের অবশ্যই বেশি দেব আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৭)

এ ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) ভ্রমণ শেষে বাড়িতে ফিরে দোয়া পড়তেন—‘আয়িবুনা ইনশাআল্লাহু তায়িবুনা আবিদুনা লি-রাব্বিনা হামিদুন।’

অর্থ : আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, ইবাদতকারী নিজ রবের প্রশংসাকারী। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৪৭)

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Comments (0)
Add Comment