মোঘল রাজকন্যা যখন ইংরেজ জলদস্যুর খপ্পরে

রিফাত আহমেদ, চেয়ারপার্সন, সিদ্দিকি'স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল

জলদস্যুতার কথা আসলেই আমদের চোখের সামনে পর্তুগীজ, আরাকানী ও ইংরেজ জলদস্যুদের ছবি ভেসে উঠে। তাদের সম্পর্কে রয়েছে নানা রকম লোমহর্ষক গল্প। আজকে এমনি এক গল্প শোনাবো।

১৬৫০ থেকে ১৭২০ পর্যন্ত সারা বিশ্বে জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ ছিল। সেই সময় মোঘলরাই ছিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী। আর এই ধনী মোঘলদের সম্পদই ছিল জলদস্যুদের অন্যতম লক্ষ্য। আকবরের রাজত্বকালে ১৫৭৩ সালে মোঘলরা সুরাত বন্দরটি দখল করে নেয়। সুরাত পশ্চিম এশিয়ার সাথে মোঘল সাম্রাজ্যের বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল এবং ১৭ শতকে এটি ভারতের সব চাইতে ধনী বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সুরাতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। বন্দরের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল রমরমা, বছরের শুল্ক আয় ছিল প্রায় ৪ লাখ রুপি। মোঘলদের শক্তিশালী করার জন্যে এই সুরাত বন্দর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এখান থেকে ভারতীয় তুলা, রেশম, গম এবং গালিচা রপ্তানির জাহাজ যেত এবং ফেরত আসত বহু সোনা ও রুপা নিয়ে। এছাড়াও এটি ভারতীয় মুসলমানদের হজ্জ তীর্থযাত্রার সূচনা পয়েন্টও ছিল। এখান থেকে প্রতি বছর মক্কায় হজ্জ যাত্রীদের জাহাজ যেত। এই কারণেই বাণিজ্য শেষে স্বদেশে ফেরতগামী জাহাজের দিকেই ছিল এই জলদস্যুদের কুদৃষ্টি।

এবার আসা যাক মূল গল্পে। এই গল্পের খলনায়ক হলেন হেনরি এভারি। তিনি ছিলেন একজন জলদস্যু।

তিনি আর্ক পাইরেট বা দ্য কিং অফ পাইরেটস নামেও পরিচিত। তিনি এক সময় রাজকীয় নৌবাহিনীতে কাজ করতেন। পরবর্তিতে অসদাচরণের জন্যে তাকে বহিস্কার করা হলে তিনি জলদস্যুতার মতো কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন। তিনি চার্লস-২ নামে যুদ্ধজাহাজে যোগ দেন। ১৬৯৪ সালে চার্লস ২-এর নাবিকরা পুরাতন ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং এভারিকে জাহাজের নতুন ক্যাপ্টেন হিসেবে মেনে নেয়। ক্যাপ্টেন হবার পরে এভারি জাহাজের নাম পরিবর্তন করে ফেঞ্চি রাখেন। তার জাহাজ ফেঞ্চি মান্দাব প্রণালীতে পৌঁছুলে সেখানে তিনি থমাস টিউ সহ চারজন জলদস্যুদের নিয়ে একটি দল গঠন করে।

ফেঞ্চি ছিল সেই সময়ের সব চেয়ে দ্রুতগামী জাহাজ। এই জাহাজ নিয়েই জলদস্যুর দল আফ্রিকা উপকূল থেকে পাঁচটি জাহাজ লুট করে এবং লোহিত সাগরে এসে মক্কা ফেরত জাহাজ গঞ্জ-ই-সাওয়াইয়ের ধন-সম্পদ লুট করার জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকে।

গঞ্জ-ই-সাওয়াই, সুরাত বন্দরের সব থেকে বড় মোঘল জাহাজ, যার অর্থ ‘অসীম সম্পদ’। ঠিক তখন মুঘলদের ২৫টি জাহাজের একটি বহর মক্কা থেকে ফিরছিল। ব্যবসা শেষে লভ্যাংশ হিসেবে গঞ্জ-ই-সাওয়াই এর সাথে ছিল বিশাল পরিমানের টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা। জাহাজ সুরক্ষার জন্য ইব্রাহিম খানের কাছে ছিল ৮০ টি কামান এবং ৪০০ টি বন্দুক। জাহাজে হজ্জ যাত্রীদের সাথে আরও ছয়শ-এর মত যাত্রী এবং মক্কা থেকে কেনা কিছু তুর্কি দাসিও ছিল।। জাহাজকে দেখে রাখার উদ্দেশ্যেই এসকর্ট হিসেবে আরও ২৪ টি জাহাজকে সাথে দেয়া হয়েছিল।

রাতে বেশিরভাগ জাহাজ এভরির পিছনে চলে যায়। জলদস্যুরা প্রথমে যে জাহাজটিকে আক্রমণ করেছিল সেটি ছিল ‘ফতেহ মোহাম্মদ’ নামে ছোট সৈন্যদলের জাহাজ। কিন্তু এই জাহাজটি তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল না। প্রধান লক্ষ্য ছিল গঞ্জ-ই-সাওয়াই।

তবে, ফতেহ মোহাম্মদ জাহাজের ক্যাপ্টেনকে হত্যা করে সেখান থেকেও প্রায় ৫০,০০০ পাউন্ড সমমূল্যের সোনা দখল করে। এরপরেই তারা আক্রমণের উদ্দেশ্যে গঞ্জ-ই-সাওয়াইকে ধাওয়া করে। গঞ্জ-ই-সাওয়াই তখন সুরাত থেকে ছিল মাত্র ৮ দিনের দূরত্বে। অন্যান্য জাহাজগুলো ছত্রভঙ্গ হওয়ায় গঞ্জ-ই-সাওয়াই এক হয়ে গিয়েছিলো।

গঞ্জ-ই-সাওয়াই এর তুলনায় ফেঞ্চি ছিল একটি হালকা জাহাজ। তাই ফেঞ্চিকে আসতে দেখে গঞ্জ-ই-সাওয়াই মোটেও ভয় পায়নি। বরং তারাই প্রথম আঘাত হানে। কিন্তু কপালের ফের, দুৰ্ভাগ্যবশতঃ তাদের একটি কামান ব্লাস্ট করে অনেক সৈন্য মারা যায়। জাহাজের এক দিকে আগুন ধরে যায়। পুরো জাহাজে তখন বিসৃঙ্খল অবস্থা। ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে আক্রমণ করে এভারি। কিন্তু বিজয় অতটাও সহজ ছিল না। মোঘল সৈন্যরা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। টানা ২ ঘন্টা যুদ্ধ শেষে এভারি জয়ী হয়।

দখলকৃত জাহাজের যাত্রীদেরকে তারা বন্দি করে নেয়। কাউকে কাউকে হত্যা করে এবং নারীদের উপর চরম নির্যাতন চালায়। সম্ভ্রম বাঁচাতে কিছু নারী পানিতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে। দখল করলেও তারা জানতো না ধন-সম্পদ গুলো কোথায় লুকানো আছে। তা খুঁজে পেতে তারা যাত্রীদের উপর আরও নির্যাতন চালায়। এক সময় তারা সেগুলো খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। লুট করা সম্পদের মধ্যে ছিল ৫০০,০০০ সোনা ও রুপার মুদ্রা, যা বর্তমান ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১১০০ হাজার কোটি রুপি।

পরবর্তীতে জলদস্যুরা নিজেদের মধ্যে ১,০০০ রুপার মুদ্রা করে ভাগাভাগি করে নেয়, যা তাদের সারা জীবনের আয়ের থেকেও অনেক বেশি ছিল।

লুটপাট চলাকালীন সময়ে ৯ জন ক্রু কোনোরকমে পালিয়ে সূরাতে চলে আসে এবং সেখানকার গভর্নর ইতিমাদ খানকে গঞ্জ-ই-সাওয়াইয়ের আক্রমণের বীভৎস বর্ণনা দেয়। গভর্নর সাথে সাথেই মোঘল যুদ্ধ জাহাজের সাথে ফ্রেঞ্চ ও ডাচদের আরও ৪ টি জাহাজ সংগ্রহ করে গঞ্জ-ই-সাওয়াইকে উদ্ধারের জন্যে পাঠায়। কিন্তু তারা খালি হাতে ফেরত আসে। তখনও গঞ্জ-ই-সাওয়াই নিখোঁজ ছিল। ২/৩ দিন পর গঞ্জ-ই-সাওয়াই ফেরত আসে। বেঁচে থাকা যাত্রীদের মুখে অত্যাচারের বীভৎস বর্ণনা শুনে সুরাতের জনগণ ভীষণ খেপে উঠে এবং ব্রিটিশদের ফ্যাক্টরিকে ঘেরাও করে। তারা নিশ্চিত ছিল এই জলদস্যুরা ব্রিটিশ ছিল এবং বোম্বের (মুম্বাই) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদস্যদের সাথে তাদের গভীর যোগাযোগ ছিল। কারণ কিছুদিন আগেই তথাকথিত চাইল্ডস ওয়ারে ব্রিটিশরা মোঘলদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। তারা মনে করেছিল সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই ছিল এই আক্রমণ।

সেই কারণেই মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কারণ ওই জাহাজে মোঘল সাম্রাজ্যের সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারের বহু মহিলা ছিল। তাছাড়াও অনেকে মনে করেন সেই জাহাজে তার নিকট আত্মীয়ও ছিল। তাই তিনি তাঁর রাজত্বের সমস্ত ইউরোপীয়দের বাণিজ্য বন্ধ করার কঠোর নির্দেশ দেন। তবে সম্রাট ছিলেন একজন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি বুঝতেন ব্যবসা ছাড়া চলবে না। তাই তিনি বিদেশী সংস্থাগুলোকে ভারতীয় জাহাজের নিরাপত্ত্বা বিধান নিশ্চিত করার জন্যে তাদেরকে বাধ্য করলেন। শেষ র্পযন্ত তারা একটি সশস্ত্র দল সরবরাহ করতে সম্মত হয় এবং চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

সম্রাটের জাহাজের আক্রমনের কথা ইংল্যান্ডে পৌঁছেছিল এবং সেই কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনে পরিচালনা বোর্ড হেনরি এভারির মাথার দাম ৫০০ ডলার রেখে ধরিয়ে দেবার ঘোষণা দেন।

আওরঙ্গজেব চূড়ান্তভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পেরেছিলেন। এদিকে, এভারির ক্রুদের বেশ কয়েকজনকে ইংল্যান্ডে আটক করা হয়েছিল।

এভারি নিজে কখনও ধরা পড়েনি। গুজব আছে, ইংল্যান্ডের ডেভনে তিনি তাঁর সারা জীবন দারিদ্র্যের মধ্যে কাটিয়েছেন। শোনা যায়, এভারি ধন-সম্পদের চেয়েও দামি কিছু পেয়েছিলেন, যা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। সে আর কেউ না, ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের রাজকন্যা। এভারি তার সাথে সংসার বাঁধেন। তাদের একটি পুত্র জন্ম নেয়, যে ‘টম সিমিলাহো’ নামে পরিচিত ছিল। ইউরোপীয়রা তাকে ‘মুলাত্তো টম’ নামে জানতো। শোনা যায়, সেই ছেলে পূর্ব মাদাগাস্কারে নিজের জন্য একটি রাজ্য তৈরি করে। এখনও মাদাগাস্কারে বসবাস করা জলদস্যুদের বংশধরদের ‘মুলাত্তো’ বলে। ইংরেজদের সর্বশ্রেষ্ঠ জলদস্যু হেনরি এভারি মৃত্যু পর্যন্ত একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে ছিলেন।

আমরা জানি ব্রিটিশ অফিসার স্লিমেন খুব কৌশলেই ভারতীয় ঠগিদের নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলো। কিন্তু ইংলিস্তানের ঠগিদের তারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আসলে এটি একটি রহস্যই বটে।


রিফাত আহমেদ,
চেয়ারপার্সন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।
কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন।

Comments (0)
Add Comment