২৫০ শয্যার হাসপাতালের ভেতরে মেডিকেল কলেজ!

কলেজটি কোচিং সেন্টারের মতো আঁটসাঁট

শিক্ষার্থীদের জন্য কমনরুম নেই। চা-নাশতা বা খাবারের জন্য কোনো ক্যানটিন নেই। ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা অবসর নেবেন, গল্প করবেন বা আড্ডা দেবেন, এমন এক ইঞ্চি খোলা জায়গা এই কলেজে নেই। পুরো কলেজ একটি কোচিং সেন্টারের মতো আঁটসাঁট। এই অবস্থা চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজের।

এই মেডিকেল কলেজটির নিজস্ব ভবন নেই। চিকিৎসাশিক্ষায় পাঠদানের জন্য নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্য কোনো আবাসনসুবিধা নেই। হাতে–কলমে শেখার জন্য নেই ল্যাবরেটরি। পড়াশোনা করার মতো লাইব্রেরি নেই। সাত বছর ধরে ১১টি কক্ষ নিয়ে চলছে চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজ। এই কলেজে ২৫০ জন শিক্ষার্থী আছেন। এ বছর আরও ৭৫ শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চলেছেন।

চাঁদপুর মেডিকেল কলেজটির অবস্থান চাঁদপুর সদর হাসপাতালের ভেতরে। সরকারি এই মেডিকেল কলেজ খুঁজতে হলে সদর হাসপাতালে যেতে হবে। ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালের চতুর্থ তলার কয়েকটি কক্ষ নিয়ে এই মেডিকেল কলেজ। এখানে ছিল রোগীদের জন্য কয়েকটি কেবিন ও পেয়িং ওয়ার্ড (ভাড়ায় পাওয়া শয্যা)। সব মিলে আয়তন সাড়ে তিন হাজার বর্গফুট। এক তলায় এমন আয়তনের বাসাবাড়ি ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে বহু মানুষের আছে।

চাঁদপুর সদর হাসপাতালের চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায়, অধ্যক্ষের কক্ষে তালা। উপাধ্যক্ষের কক্ষ খোলা থাকলেও তিনি অনুপস্থিত। তখনো কলেজের হেড ক্লার্ক (প্রধান করণিক) এসে কর্মস্থলে পৌঁছাননি।


চাঁদপুর মেডিকেল কলেজটির অবস্থান চাঁদপুর সদর হাসপাতালের ভেতরে।ছবি: সংগৃহীত

সদর হাসপাতালের চতুর্থ তলার এক পাশে থাকা পেয়িং ওয়ার্ড ও কয়েকটি কেবিন বন্ধ করে কলেজ চালু করা হয়েছে। গুনে দেখা গেল, এখানে কক্ষ মোট ১১টি। কলেজের যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ হয় দুটি কক্ষে। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের দুটি পৃথক কক্ষ। বাকি সব শিক্ষকের জন্য একটি কক্ষ। তিনটি কক্ষে ফিজিওলজি ল্যাব, বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাব ও অ্যানাটমি ল্যাব। পাঠদানের বড় শ্রেণিকক্ষ মাত্র দুটি। আর একটি কক্ষের সামনে লেখা লাইব্রেরি। সেখানে কয়েকটি টেবিল ও চেয়ার রাখা আছে। কোনো বই, বইয়ের তাক চোখে পড়ল না।

অফিস, অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে তিনটি টয়লেট। আর শিক্ষার্থীদের দুটি টয়লেট পাশাপাশি, একটি ছাত্রদের, অন্যটি ছাত্রীদের জন্য। কলেজের একজন ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাবতে পারেন, কলেজের প্রায় ২০০ ছাত্রীর জন্য মাত্র একটি টয়লেট!’

কলেজটিতে কোনো প্রাণচাঞ্চল্য চোখে পড়ল না। সকাল ৯টা থাকে ১০টা পর্যন্ত কিছু শিক্ষার্থীকে যাওয়া-আসা করতে দেখা গেল। এ সময়ে দুটি ক্লাস হয়েছে। একেকটি ক্লাসে ১৫-২০ জন করে শিক্ষার্থী, ৮০ শতাংশের ওপর ছাত্রী।

অ্যানাটমি চিকিৎসাশিক্ষা ও চিকিৎসা পেশার একেবারে মৌলিক বিষয়। কিন্তু এ বিষয়ে একজনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা শিক্ষক কলেজে নেই। অর্থাৎ অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক নেই। এই বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন সার্জারি বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক। শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে পাঠ দেওয়ার জন্য দেশের অন্য স্থান থেকে ‘অতিথি প্রভাষক’ আনা হয়। ফিজিওলজি বিভাগে কোনো অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক নেই। একজন সহকারী অধ্যাপক দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।

একেকটি ক্লাসে ১৫-২০ জন করে শিক্ষার্থী, ৮০ শতাংশের ওপর ছাত্রী। ছবি: সংগৃহীত

কলেজ থেকে পাওয়া একটি হিসাব বলছে, ৬টি বিভাগে প্রভাষকের পদ আছে ২০টি। এর মধ্যে ৮টি পদ শূন্য। পুরো কলেজে অধ্যাপক আছেন মাত্র দুজন। এর একজন অধ্যক্ষ। এ বিষয়ে অধ্যক্ষ সাহেলা নাজনীন বলেন, ‘সব শিক্ষক একসঙ্গে কলেজে এলে বিপদে পড়ে যাই। তাদের একসঙ্গে বসতে দেওয়ার মতো জায়গা নেই।’

কলেজের অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং শিক্ষক স্বল্পতার বর্ণনা দিতে দিতে সাহেলা নাজনীন বলেন, ‘দুঃখ এই যে আমরা কোয়ালিটি (মানসম্পন্ন) চিকিৎসক তৈরি করতে পারছি না।’

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালে মেডিকেল কলেজটি প্রতিষ্ঠা করে। ইতিমধ্যে একটি ব্যাচ এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্নশিপ শুরু করেছে। কিন্তু হাসপাতালে এসব নবীন চিকিৎসক দরকারি প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না। অসম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের ইন্টার্নশিপও শেষ হবে। প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা ছাড়াই একদল চিকিৎসক দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যুক্ত হতে যাচ্ছেন।