মুর্শিদাবাদে বাবরি মসজিদ: ভারতীয় মুসলিমদের ধর্মীয় মর্যাদাকে নতুনভাবে দৃঢ় করার চেষ্টা

ভারতের ইতিহাসে বাবরি মসজিদের নাম শুনলেই বহু মানুষের মনে ফিরে আসে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের সেই দগদগে দিন, যেদিন শতাব্দী-প্রাচীন মসজিদটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সময় গড়িয়েছে তিন দশকেরও বেশি; রাজনৈতিক সমীকরণ বদলেছে, মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু বাবরির স্মৃতি এখনো ভারতীয় মুসলমানদের হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে। সেই স্মৃতি জিইয়ে রাখতেই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে নতুন করে বাবরি মসজিদের আদলে একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ। এই উদ্যোগ ভারতজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় ইতোমধ্যেই মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতা হুমায়ুন কবিরের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই প্রকল্প মুহূর্তেই ভারতের মুসলিম সমাজে আলোড়ন তোলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ছবি ও ভিডিও। ভারতীয় মুসলিম তথা বিশ্ব ‍মুসলিম উম্মাহর উচ্ছ্বাস-উৎসাহ এক ধরনের আত্মিক বিজয়ের অনুভূতি যেন। মুসলমানদের ভাষ্য, রামমন্দির উঠে গেছে, কিন্তু আমরা তো চেয়েছিলাম আমাদের ইতিহাসের এক টুকরো ফিরে আসুক। এই নির্মাণ যেন সেই স্বপ্ন পূরণের শুরু। মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দেয়ার পর দুদিনেই কয়েক কোটি রুপির অনুদান জমা পড়েছে। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ এসে অর্থ দিচ্ছেন। কেউ একটি ইট, এক বস্তা বালু নিয়ে হাজির হচ্ছেন। কেউ কেউ ১০০ থেকে ১০ হাজার রুপি, কেউ বা আবার লাখ টাকাও দান করছেন।

মুঘল সম্রাট বাবরের নামে নামকরণ করা বাবরি মসজিদে যেদিন শাবল চালানো হয়েছিল, দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমানদের হৃদয় সেদিন চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিল। বুক চিতিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিল লাখো মুসলমান। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ উগ্র হিন্দুদের মনে মুসলমানদের রক্তগঙ্গা সেদিন খুব একটা আলোড়ন তোলেনি। বরং তারা মুসলিম নিধনের এ অভিযানে ছিল কঠোর। মুসলমানদের আহাজারিতে উল্লাসিত হয়েছে তাদের মন, উৎফুল্ল হয়েছে বহু হৃদয়। সত্য ও ন্যায়ের শিখাকে নিভিয়ে ফেলার প্রবল প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে স্পষ্ট ছিল।

কেন এই বিদ্বেষ ও নির্মমতা? মুসলমানদের অপরাধই-বা কী? সাহাবাদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য মুসলিম স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে, বহু মসজিদ ধ্বংস কার হয়েছে। এর মধ্যে ইতিহাসের অন্যতম করুণ অধ্যায় হলো এই বাবরি মসজিদ ধ্বংস। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫২৫ সালে পরপর চারটি যুদ্ধ শেষে সম্রাট বাবর ভারতবর্ষে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠায় সফল হন। ১৫২৮ সালে তিনি উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা অঞ্চলে তাশকন্দের মীর বাকিকে গভর্নর নিযুক্ত করেন। তার অধীনে ১৫৩৮ সালে অযোধ্যার ফয়জাবাদে একখণ্ড পতিত জমিতে নির্মিত হয় বাবরি মসজিদ।

ভারতে মুসলিম আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি কিছু কট্টর হিন্দু গোষ্ঠী। মুসলিম বিজয় তাদের মনে ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। মুসলমানদের ক্ষতিসাধনে নানা ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত হয়। বাবরি মসজিদ নির্মাণের শতাব্দী পর সেই প্রাচীন জমিকে রাম মন্দিরের দাবি তুলে তারা সারাদেশে উসকানি ছড়ায়। বহুবার হামলা চালানো হয় মসজিদে; মিছিল–উল্লাসে তারা এই আক্রমণকে বৈধতা দিতে থাকে।

 

ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমানদের অবস্থা আরও অবনতি ঘটে। প্রকাশ্যে আজান বা জামাতে নামাজ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা আসে। বাবরি মসজিদে হামলা চলতেই থাকে। ১৮৮৫ সালে কট্টর হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভাঙতে আবার উদ্যোগী হয়। মুসলমানরা প্রতিরোধে এগিয়ে এলে সংঘর্ষ বাঁধে—উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের মুখে মুসলিম প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। সেদিন ফয়জাবাদের মাটিতে ৭৫ জন মুসলমান শহিদ হন।

১৮৮৭ সালে আবারও হামলা চালানো হলে মুসলমানরা প্রাণপণ লড়াই করে, কিন্তু শহিদদের লাশ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর মসজিদ চত্বরের কিছু অংশ দখল করে সেখানে ছোট একটি রামপূজার বেদি স্থাপন করা হয়। মুসলমানরা মসজিদে ইবাদত অব্যাহত রাখে, ফলে একই স্থানে মসজিদ ও রামপূজা দুটিই চলতে থাকে; যা গভীর বেদনা ও ক্ষোভের জন্ম দেয় মুসলমানদের মাঝে।

১৯৩৪ সালে ভারতজুড়ে হিন্দু–মুসলিম দাঙ্গার সময় বাবরি মসজিদে পুনরায় হামলা হয় এবং মসজিদের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৪৯ সালে হঠাৎ একদল উগ্র হিন্দু মসজিদের ভেতরে রামের মূর্তি স্থাপন করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। সরকার এলাকাটি, বিরোধপূর্ণ ঘোষণা করে। মুসলমানরা নামাজ আদায় করতে না পারলেও হিন্দুরা পূজা চালিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তীতে মুসলমানরা মসজিদ দখলে নিয়ে তালা লাগায়, যার ফলে হিন্দুরা সাময়িকভাবে পূজা করতে পারে না।

১৯৮৩ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মন্দির নির্মাণের দাবি তোলে এবং মুসলমানদের তালা খুলে দিতে আহ্বান জানায়, যা মুসলমানরা প্রত্যাখ্যান করে। একই বছর জেলা জজ বাবরি মসজিদের তালা খুলে রামপূজার অনুমতি দেন। এতে মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হয়ে ‘বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে, যারা মসজিদ রক্ষায় জীবন উৎসর্গের অঙ্গীকার করে। ১৯৮৭ সালে তাদের ডাকে কালো দিবস পালিত হয় এবং দেশব্যাপী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৮৯ সালে হিন্দু পরিষদ ও বিজেপিসহ বিভিন্ন সংগঠন মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের ঘোষণা দেয়। একই বছর ২ নভেম্বর তারা বাবরি মসজিদে নিজেদের পতাকা তোলে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের নীরব সমর্থনেই এটি সম্ভব হয়েছিল। ১৯৯০ সালে লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে রথযাত্রা শুরু হলে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটে। রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধের মুখে আদভানি গ্রেপ্তার হন; এতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু লোক নিহত হয়।

নরসীমা রাওয়ের সময়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হলেও বিরোধের কারণে তা তিন মাস স্থগিত থাকে। কিন্তু ১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর লাখো মানুষের উপস্থিতিতে উগ্র হিন্দুদের একটি বড় দল বাবরি মসজিদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে। কিছু যুবক ধ্বংসস্তূপে অশালীন আচরণ করে, যা মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। ৬ ডিসেম্বর ধ্বংসের পর সারা ভারতজুড়ে ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এদিন ও পরদিন ২৩৭ জন মুসলমান নিহত হন। উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকার বরখাস্ত করা হয় এবং প্রেসিডেন্ট রুল জারি হয়। ৭ ডিসেম্বরের সহিংসতায় দিল্লি, আহমদাবাদ, জয়পুর, ভুপাল, এলাহাবাদ, মুম্বাইসহ বহু এলাকায় প্রায় এক হাজার মুসলমান নিহত হন। পরবর্তী দিনগুলোতে গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ ও কর্ণাটকে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বহু শহরে সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করলে দেড় হাজারের বেশি মুসলমান নিহত হন। ১০-১১ ডিসেম্বরও দাঙ্গা থামেনি; মুসলিম জনপদে আগুন লাগানো, নারী-শিশুদের ওপর নির্যাতন, ব্যাপক লুটতরাজ ছড়িয়ে পড়ে।

ওই সহিংসতায় কয়েক হাজার মুসলমান নিহত হন। কলকাতা ও হাওড়ায় কারফিউ জারি হলেও পুলিশি নির্যাতন অব্যাহত থাকে। মুসলমানদের ব্যবসা বাণিজ্যে হামলা হয়, বহু প্রতিষ্ঠান দখল হয়ে যায়। কর্মস্থলে মুসলমানদের প্রবেশ ঠেকাতে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। অব্যাহত সহিংসতার প্রতিবাদে মুসলমানরা প্রজাতন্ত্র দিবস বর্জন করে। একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মসজিদ ভাঙার ঘটনা বিশ্বকে বিস্মিত করে। অনেকের মতে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস ছিল ভারতে মুসলমানদের দমননির্মূলের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। যে যুবক সর্বশেষ গম্বুজটি ভেঙেছিল, সে সাক্ষাৎকারে বলেছিল, আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছি।

সময়ের বাঁকবদল। তিন দশকেরও বেশি সময় পর মুর্শিদাবাদে নতুন করে বাবরি মসজিদ নির্মাণ, এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় প্রতীকী ঘটনা। এই নির্মাণ ভবিষ্যতে ভারতের ধর্মীয়-সামাজিক ইতিহাসে কী প্রভাব ফেলবে, সেটি এখনই বলা কঠিন। তবে এটুকু নিশ্চিত, কয়েক যুগ আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাবরির স্মৃতি আবার নতুনভাবে আলোচনায় ফিরে এসেছে এবং মুসলিম সমাজে জেগে উঠেছে নতুন চেতনা ও উৎসাহে।