‘ওয়ার্কিং পিপল অ্যাগেইনস্ট অ্যাপার্টহাইড অ্যান্ড জেনোসাইড ইন গাজা’ শীর্ষক এক সভায় ভারতের বুকার পুরস্কারজয়ী কথাসাহিত্যিক অরুন্ধতী রায় এই বক্তব্য রাখেন। এই বক্তব্যে অরুন্ধতী ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে মতামত প্রদান করেন। ৭ মার্চ নয়াদিল্লি প্রেস ক্লাবে প্রদত্ত এই বক্তৃতা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্ক্রল ডট ইন থেকে ভাষান্তর করেছেন শাহেরীন আরাফাতঃ
পশ্চিমা বিশ্বের ধনী ও শক্তিশালী দেশগুলো যারা নিজেদের আধুনিক বিশ্বের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রক্ষক বলে মনে করে, তারা গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যাকে প্রকাশ্যে অর্থায়ন ও প্রশংসা করছে। গাজা উপত্যকাকে বন্দি শিবিরে পরিণত করা হয়েছে। যারা এখনও নিহত হননি, তাদের অনাহারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। গাজার প্রায় পুরো জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের বাড়িঘর, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর, সব ধরনের অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাদের সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে। তাদের অতীত উধাও করে দেওয়া হয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
যদিও বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত বিশ্বাস করেন যে, প্রায় প্রতিটি সূচকই গণহত্যার আইনি সংজ্ঞা পূরণ করে; তবে আইডিএফ (ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস) সেনাসদস্যরা তাদের ভ্রান্ত ‘বিজয়ী ভিডিও’ বানিয়ে উদযাপন করে চলেছে, যা প্রায় পৈশাচিক আচরণের মতো দেখায়। তাদের বিশ্বাস– পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই, যা তাদের হিসাবের খাতায় তুলতে পারে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল। কৃতকর্ম তাদের ও তাদের ছেলেমেয়েকে তাড়িয়ে বেড়াবে। বিশ্ব যে বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার অনুভূতি তাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে, তা নিয়েই তাদের বাঁচতে হবে। আর আশা করি, একদিন সবাই সংঘাতের যে পক্ষেই অবস্থান করুন না কেন– যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের বিচার করা হবে এবং শাস্তি দেওয়া হবে। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, বর্ণবাদ এবং দখলদারিত্ব প্রতিরোধের সময় সংঘটিত অপরাধ এবং সেই দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংঘটিত অপরাধের মধ্যে কোনো তুলনা চলে না।
বর্ণবাদ অবশ্যই গণহত্যার অন্যতম চাবিকাঠি। ইসরায়েলের জন্মের শুরু থেকেই তার কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে আসছে এবং তাদের পোকামাকড়ের সঙ্গে তুলনা করছে; ঠিক যেমনভাবে নাৎসিরা একসময় ইহুদিদের প্রতি অমানবিক আচরণ করেছিল। যেন সেই শয়তানের নির্যাস কখনও দূরে সরে যায়নি এবং এখন সেটি পুনঃপ্রবর্তিত হয়েছে। শক্তিশালী স্লোগান ‘আবার কখনই না’ (নেভার অ্যাগেইন) থেকে ‘কখনই না’ (নেভার) বাদ দেওয়া হয়। আর আমাদের জন্য শুধু বরাদ্দ থাকল ‘আবার’ (অ্যাগেইন)।
আবার কখনই না
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের সামনে অসহায়, যদিও মার্কিন অর্থায়ন ছাড়া ইসরায়েলের অস্তিত্বই থাকত না। যেন পরগাছা মহীরুহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। দৃষ্টিবিজ্ঞান আমাদের এমনটাই বলছে। যখন ইসরায়েলি সরকার এবং সামরিক কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে জো বাইডেনকে অস্বীকার করছে এবং তারা যা শুরু করেছে তা শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে; তখন একজন বার্ধক্যপীড়িত শিশুর মতো বাইডেন যেন আইসক্রিম চাটতে চাটতে ক্যামেরার সামনে উপস্থিত হন; আর অস্পষ্টভাবে যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে বিড়বিড় করেন! লাখো তরুণ আমেরিকান, যারা তাদের নামে চলা এই হত্যাকাণ্ডের পক্ষে দাঁড়াতে রাজি নন, ভোটে তাদের পক্ষে টানতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে। অথচ ইসরায়েলি গণহত্যায় এখনো তাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার প্রবাহিত হচ্ছে।
আর ভারতের কী হবে?
এটি সুপরিচিত যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তাঁর সহানুভূতি কার প্রতি, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভারত এখন আর ফিলিস্তিনের বন্ধু নয়। বোমা হামলা শুরু হলে, মোদির হাজার হাজার সমর্থক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ডিসপ্লে ছবি হিসেবে ইসরায়েলের পতাকা তুলে ধরে। তারা ইসরায়েল ও আইডিএফের পক্ষে জঘন্যতম মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করে। যদিও ভারত সরকার এখন আরও নিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরে এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য হলো– এই নীতি একযোগে সব পক্ষে থাকতে পারে। গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিতে পারে; আবার গণহত্যাবিরোধীও হতে পারে। সরকার স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা যে কোনো ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবেই ব্যবস্থা নেবে।
আর এখন যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রচুর উদ্বৃত্ত অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের নামে ইসরায়েলের গণহত্যায় পাঠাচ্ছে; ভারতও নিজ দেশের উদ্বৃত্ত বেকার দরিদ্র মানুষকে ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের স্থলাভিষিক্ত করতে ইসরায়েলে পাঠাচ্ছে। ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের আর ইসরায়েলে প্রবেশ করে কাজের অনুমতি দেওয়া হবে না। আমি অনুমান করছি, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে কোনো মুসলমান থাকবে না। যারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে যথেষ্ট মরিয়া। যারা ভারতীয়দের প্রতি ইসরায়েলি বর্ণবাদ সহ্য করতে প্রস্তুত। আপনি যদি একটু ভালো করে লক্ষ্য করুন, তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসবের প্রকাশ দেখতে পাবেন। মার্কিন অর্থ এবং ভারতীয় দারিদ্র্য ইসরায়েলি গণহত্যার যুদ্ধ মেশিনে তেলের জোগান দেয়। কী ভয়ানক, অভাবনীয়, লজ্জাকর!
ফিলিস্তিনিরা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর মুখোমুখি; এমনকি তাদের মিত্ররা দূরে সরে গেছে। সীমাহীন দুর্ভোগে তারা একাকী। কিন্তু এই যুদ্ধে তারা জয়ী হয়েছে। তারা, তাদের সাংবাদিক, ডাক্তার, উদ্ধারকারী দল, কবি, শিক্ষাবিদ, মুখপাত্র, এমনকি তাদের সন্তানরাও সাহস ও মর্যাদার সঙ্গে নিজেদের পরিচালনা করেছে, যা বাকি বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রজন্মের তরুণ ইহুদিরা মগজ ধোলাই ও প্রপাগান্ডা দেখে বড় হয়েছে এবং এটিকে বর্ণবাদ ও গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর সরকার আবারও মর্যাদা হারিয়েছে; যদি আদৌ কোনো সম্মান তাদের অবশিষ্ট থেকে থাকে। অথচ বিশ্বের ভবিষ্যৎ বাঁচানোর আশায় ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লাখো বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে এসেছেন। ফিলিস্তিন মুক্ত হবেই।