১৯৩২ -২০২০ সাল। এই ৮৮ টি বসন্ত পার করা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ আর আমাদের মাঝে নেই। জীবন চলার এই দীর্ঘ সময়ে এই আদর্শবান শিক্ষক বহু কীর্তি গড়েছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কথা বলেছেন, নীতি বাতলে দিয়েছেন। সংকটে জাতিকে দিশা দিয়েছেন এই আলোকিত মানুষটি। দল-মত নির্বিশেষে সবার অতি আপন এমাজউদ্দীন আহমদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ভিসির সঙ্গে যারা মিশেছেন, তাকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করেন যে, মানুষটি অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। সদা দিয়েই গেছেন, তার মধ্যে পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল না বললেই চলে। এই জ্ঞানী মানুষটি বহু মানুষের জীবন গড়ার কারিগর। তার ছাত্ররা মন্ত্রিসভার সদস্য, রাষ্ট্রদূত, সচিব, রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিক।
এমাজউদ্দীন আহমদের সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি ছিলেন নিরহংকারী। পরম মমতা দিয়ে মানুষকে কাছে টানতে পারতেন। দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হলেও তার কাছে এক্সেস ছিল সবার।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯৩২ সালে অবিভক্ত বাংলার মালদহে। ভারত ভাগের পর তার পরিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে আসে।
শিবগঞ্জের আদিনা সরকারি ফজলুল হক কলেজ ও রাজশাহী কলেজে পড়ালেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এমাজউদ্দীন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফজলুল হক হলের ভিপি পদে নির্বাচিত হন।
স্নাতকোত্তর শেষ করে রাজশাহী কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে এমাজউদ্দীনের পেশাজীবনের শুরু।
পরে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসে ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন এমাজউদ্দীন। তিনি পিএইচডি করেন কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দীর্ঘদিন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা এমাজউদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও প্রোভিসির দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৯২ সালে তাকে দেয়া হয় উপাচার্যের দায়িত্ব। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদেই ছিলেন।
১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর ইউনির্ভাসিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভে (ইউডা) যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পৃক্ততা ছিল তার।
গবেষক-পর্যালোচক হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের। তিনি আমৃত্যু তুলনামূলক রাজনীতি, প্রশাসন ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক বাহিনী সম্পর্কে গবেষণা করে গেছেন। তার লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির বেশি। তার লেখা বই দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে তার প্রকাশিত গবেষণামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা শতাধিক।
এমাজউদ্দীন আহমদ পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন নিয়মিত। রাষ্ট্রনীতি পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তার লেখা কলামের গভীরতা ছিল অনেক।
শিক্ষাক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৯২ সালে তাকে একুশে পদক দেয়।
এ ছাড়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত গোল্ড মডেল, শেরেবাংলা স্মৃতি স্বর্ণপদক, ঢাকা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ যুব ফ্রন্ট গোল্ড মেডেল, মহাকাল কৃষ্টি চিন্তা সংঘ স্বর্ণপদক, জাতীয় সাহিত্য সংসদ স্বর্ণপদক, জিয়া সাংস্কৃতিক স্বর্ণপদক, রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরাম স্বর্ণপদকসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু পুরস্কার-সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।
তার স্ত্রী সেলিমা আহমদ ২০১৬ সালে মারা যান। অধ্যাপক দিলরুবা শওকতা আরা ইয়াসমিন ও অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন তাদের দুই মেয়ে। দুই ছেলের মধ্যে জিয়া হাসান ইবনে আহমদ সরকারি কর্মকর্তা, তানভীর ইকবাল ইবনে আহমদ একজন চিকিৎসক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিন্নাত আরা নাজনীন জানান, শুক্রবার দুপুরে জুমার পর কাঁটাবন ঢাল মসজিদে তার বাবার জানাজা হবে। আসরের পর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
শুক্রবার সকালে ধানমণ্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এমাজউদ্দীন আহমদের মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।