গত চার মাসে দেশের থানা ও আদালতগুলোতে নতুন মামলা হয়েছে আরও দুই লাখ। এর ফলে নতুন ও পুরোনো মামলা মিলিয়ে মামলার জট এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ লাখে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রম চললেও মামলাজট নিরসনে এর প্রভাব পড়েনি। কারণ, ভার্চুয়াল আদালতকে জামিন ও কিছুসংখ্যক দেওয়ানি মামলার নিষেধাজ্ঞার বিষয় ছাড়া অন্য কোনো মামলা নিষ্পত্তির এখতিয়ার দেওয়া হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, করোনাকালে গত চার মাসে দেশের আদালতগুলোতে জামিন ও আত্মসমর্পণ-সংক্রান্ত আবেদন জমা হয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার ৩৯৯টি। আইনজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে দ্রুত মামলাজট নিরসনে বিচার বিভাগের বার্ষিক ছুটি বাতিলের পাশাপাশি দৈনন্দিন কর্মঘণ্টা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি আইনি কাঠামোর আওতায় আদালতের মধ্যস্থতায় (এডিআর) বাদী-বিবাদী এবং সংশ্নিষ্ট পক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে ছোটখাটো মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে মনোযোগী হতে হবে। অনেক আইনজীবী বর্তমান পরিস্থিতিতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত আদালত চালুর দাবি জানিয়েছেন।
গত দুই বছরের মামলাজট পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছর দেশের সব আদালতে মামলা হয় ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭০টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৯৩৫টি। এর ফলে ২০১৮ সালের তুলনায় গত বছরে দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে মামলাজট বেড়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৭৮টি। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট মামলাজট ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি। এর সঙ্গে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের বিবরণী শাখার খসড়া অনুযায়ী আরও দেড় লাখ নতুন মামলা যুক্ত হবে। এ ছাড়া করোনাকালে আদালতগুলোতে হওয়া প্রায় দুই লাখ জামিন আবেদনসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি-সংক্রান্ত অন্যান্য মামলা মিলিয়ে মামলাজট এখন প্রায় ৪০ লাখে পৌঁছেছে।
থমকে আছে বিবরণী শাখার কার্যক্রম :সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হচ্ছে মামলার পরিসংখ্যান তৈরি করা। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বছরে চারটি বিবরণীর পাশাপাশি একটি বার্ষিক বিবরণীও প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তবে করোনার কারণে চলতি বছরের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও প্রথম ত্রৈমাসিক বিবরণী এখনও প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিকভাবে একটি খসড়া করা হলেও জেলাগুলো থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য না আসায় থমকে আছে এ কার্যক্রম। তা ছাড়া করোনা সংক্রমণ এড়াতে বিবরণী শাখায় জনবলেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ও জেলা আদালতগুলোতে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করোনা সংক্রমণ এড়াতে পর্যায়ক্রমে অফিস করছেন তারা। তাই তথ্য সংগ্রহ এবং বিবরণী তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে।
বিচারকের স্বল্পতা ও নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত :দেশের আদালতগুলোতে মামলাজট বাড়লেও সেই অনুপাতে বিচারক নিয়োগ হচ্ছে না। যদিও ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত উচ্চ ও অধস্তন আদালতে প্রায় ৯০০ বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে উচ্চ আদালতে ১০৩ জন বিচারপতি এবং অধস্তন আদালতে এক হাজার ৯২০ জন বিচারক কর্মরত আছেন। ত্রয়োদশ বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষার মাধ্যমে আরও ১০০ বিচারক নিয়োগের ভাইভা পরীক্ষা বর্তমানে স্থগিত রয়েছে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গত ১৮ মার্চ লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৪২০ জনের ভাইভা পরীক্ষার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
মামলাজট নিরসনের উপায় :দেশে বিদ্যমান দেওয়ানি কার্যবিধির বয়স ১১১ বছর। ফৌজদারি কার্যবিধির বয়স ১২১ বছর। সাক্ষ্য আইনের বয়স ১৪৭ বছর, যা বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেকটাই অকার্যকর। বিচারপ্রার্থী মানুষকে দ্রুত প্রতিকার দিতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি শতাব্দীপ্রাচীন এসব আইনের ব্যাপক সংস্কার ও প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন জরুরি। এর মধ্যে ১৮৭২ সালে প্রণীত সাক্ষ্য আইনের ৪৫ থেকে ৫১ ধারায় বিশেষজ্ঞের অভিমত, ৫৬ থেকে ৫৮ ধারা এবং ৩০ ও ৯০ ধারা অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন। এর মধ্যে ৬০ ধারায় সংশোধনী আনা হলে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন উপাদান, যেমন- মোবাইল, অডিও, ভিডিও, স্থিরচিত্র ইত্যাদিতে প্রদত্ত বক্তব্য মৌখিক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হবে। এতে প্রকৃত ঘটনাও প্রমাণিত হবে এবং সার্বিকভাবে মামলা-মোকদ্দমার দ্রুত নিষ্পত্তিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।