মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল প্রস্তুত থাকলেও টার্মিনালের কাজ শুরুই হয়নি। অথচ পলি জমে চ্যানেলের গভীরতা ১০ মিটারে নেমে আসায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জাহাজ ভেড়াতে সমস্যা হচ্ছে। আবার আয় না থাকলেও ১৪ কিলোমিটার চ্যানেলের রক্ষণাবেক্ষণে বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যয় হবে সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকা। তাই কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিকেও ড্রেজিংয়ের ব্যয় বহনে অংশীদার হতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেইসঙ্গে কম খরচে চ্যানেল সচল রাখতে প্রথমবার খনন শুরু হয়েছে নিজস্ব ড্রেজার দিয়ে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চ্যানেল নির্মাণ ঘিরে পাঁচ বছর আগে মাতারবাড়িতে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গেল চার বছরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চ্যানেল নির্মিত হলেও মূল টার্মিনালের কাজ এখনো শুরু হয়নি। প্রতি মাসে গড়ে ৬৩ হাজার টন ধারণক্ষমতার চার থেকে পাঁচটি জাহাজ ভিড়ে এখানে। এ অবস্থায় চ্যানেলের গভীরতা ১৬ থেকে ১০ মিটারে নেমে আসায় ব্যাহত হচ্ছে কয়লাবাহী বড় জাহাজ চলাচল।
এর আগে শুধু কর্ণফুলী নদীতে ড্রেজিং করা হতো। ছয় বছর বিকল থাকার পরে ২০ কোটি টাকায় মেরামত শেষে ২০২৪ এ কর্ণফুলী নদী খননে পুনরায় যুক্ত হয় খনক। কয়েকবার ট্রায়ালের পর রবিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) থেকে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রে ড্রেজিংয়ে খনক কাজ শুরু করে। এই জাহাজ দিয়ে বর্ষা মৌসুমের আগে মাতারবাড়ি চ্যানেলের নাব্যতা ১৩ মিটারে বাড়াতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার সামসীত তাবরীজ বলেন, ‘যদি গভীরতা কমে যায় আমাদের বড় জাহাজ আসতে অবশ্যই সমস্যা সৃষ্টি হবে। আমরা চেষ্টা করছি যেন আমাদের টার্গেট যেটা, সেই ১৬ মিটার গভীরতা যেন আমরা ধরে রাখতে পারি। সেজন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
গভীর সমুদ্র বন্দরের বাণিজ্যিক যাত্রার আগ পর্যন্ত চ্যানেলটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চট্টগ্রাম বন্দরের। সমীক্ষা অনুযায়ী চ্যানেল খননে চার বছরে ব্যয় হবে আড়াই হাজার কোটি টাকা। চ্যানেল নির্মাণের নয় হাজার কোটি টাকার দেনার সঙ্গে এই হাতির খোরাক জোগানো এখন বন্দরের জন্য বড় বোঝা। তাই ব্যয় শেয়ারের ভাগ কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিকে দিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে বন্দর। সেই সঙ্গে নিজস্ব ড্রেজার ব্যবহার করে খনন ব্যয় ৩৫ কোটি টাকা করার টার্গেট তাদের।
কমান্ডার সামসীত তাবরীজ বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত বন্দরের ফুল অপারেশন শুরু হয়নি। তো যেহেতু সীমিত আয়, আমরা আমাদের মিনিমাম খরচের মাধ্যমে ম্যাক্সিমাম আউটপুটের চেষ্টা করছি। তারপরও যদি ডিজাইন অনুযায়ী ফুল ক্যাপাসিটিতে খরচের যে ব্যাপারটা আছে সেটা আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গভীর সমুদ্রে ড্রেজিংয়ে প্রথম পর্যায়ে খননে বেগ পেতে হচ্ছে। প্রতিটি ট্রিপে নয় দিনে খনন করা হবে এক লাখ ঘনমিটার পলি। প্রয়োজনীয় মেইনটেন্যান্স করে এটি নিয়মিত খনন চালিয়ে যাবে। তবে চ্যানেল খননের জন্য একটি ড্রেজারই যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাই আরেকটি নতুন ড্রেজার কিনতে প্রকল্প নিচ্ছে বন্দর।
ড্রেজার জাহাজ খনকের ক্যাপ্টেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আশিক মাহমুদ বলেন, ‘এখানের সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে মেইনটেন্যান্স করা। কোকো ধরনের মেশিনারিজ ব্রেকডাউন হলে আমরা বন্দর থেকে অনেক দূরে থাকার কারণে এখানে মেইনটেন্যান্স পেতে আমাদের বেগ পেতে হয়। একটা ড্রেজার দিয়ে আমরা যে পরিমাণ বালি তুলি, সেটা তুলে ঠিক করতে অনেক সময় লাগবে। সেজন্য আমার মতে এখানে আরও একটি ড্রেজার হলে ভালো হতো।’
২০২০ সাল থেকে এই চ্যানেল ব্যবহার করে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে ভিড়েছে ১৫৭ টি জাহাজ। এর বিপরীতে টাগবোট সার্ভিসসহ নানা খাতে চট্টগ্রাম বন্দর চার বছরে আয় করেছে মাত্র ২০ কোটি টাকা। আর বন্দর নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা।
ব্যবসায়ীদের মতে, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের উপর নির্ভরতা ঘুচাবে মাতারবাড়ি বন্দর। রপ্তানি পণ্য সরাসরি পৌঁছে যাবে ইউরোপ, আমেরিকার বন্দরে। তবে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য, চীন, মিয়ানমারসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক সংযোগ স্থাপিত না হলে তা কতটুকু কার্যকর হবে সেটি নিয়ে সংশয় রয়েছে।