চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) দেশের তরুণ-তরুণীদের উপরে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সেই জরিপে দেখা গেছে, মহামারির আগে চাকরিতে নিযুক্ত থাকলেও এই তরুণ-তরুণীদের ১৫ শতাংশ মহামারীর পর কর্মহীন হয়েছে। তাদের শিক্ষার নিম্নমান, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার অভাব থাকার পাশাপাশি কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় শ্রম বাজারে ইতোমধ্যেই তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। মহামারিকালীন তরুণদের জন্য প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়েছে। ২২ জুন বিআইজিডির গবেষকরা এক ওয়েবিনারে তাদের এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন।
কৃষিকাজ, দিনমজুর কিংবা পরিবহন শ্রমিকদের মতো তুলনামূলক কম দক্ষ কর্মীদের চেয়ে দক্ষতা নির্ভর পেশা যেমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাখাত, হস্তশিল্প ইত্যাদিতে জড়িত তরুণ পেশাজীবীরা বেশি সময় ধরে বেকার থাকছেন। যারা আবারও চাকরি যোগাড় করতে পেরেছেন, তাদের গড় আয় কভিড-পূর্ব অবস্থার তুলনায় ১১ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। শহরাঞ্চলের তরুণদের আয়ে বেশ বড়রকমের ধাক্কা লেগেছে, ১৫ শতাংশ আয় কমেছে তাদের। সে তুলনায় গ্রামাঞ্চলের তরুণদের আয় কমেছে ৯ শতাংশ পর্যন্ত।
আজহারুল ইসলাম খান, মহাপরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অনুষ্ঠানে জানান, আমরা ভাগ্যবান কারণ আমাদের দেশে বর্তমানে তরুণদের সংখ্যা বেশি। আমাদের এটির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
নারীদের অবস্থা আরো আশঙ্কাজনক। মহামারির আগে চাকরিরত তরুণীদের এক তৃতীয়াংশ ২০২১ সালের জানুয়ারিতে তাদের চাকরি হারিয়েছেন। চাকরি হারানোর এই হার তরুণদের চেয়ে তিন গুণ বেশি। অন্যদিকে, মহামারির আগে এবং পরে উভয়সময়ে চাকরিতে যোগদান করা নারীদের আয় কমে যাওয়ার হার পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ তরুণদের আয় ১০ শতাংশ কমলেও তরুণীদের ক্ষেত্রে তা কমেছে ২১ শতাংশ।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড ইকোনমিক্সের সহকারী অধ্যাপক ড. জেনিফার সিয়েগার জানান, আর্থিক সংকট তরুণ-তরুণীদের মাঝে চাকরি ও শিক্ষার আগ্রহকে হ্রাস করছে।
এই গবেষণায় অংশ নেয়া তরুণীরা মহামারীর সময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু খাত যেমন গৃহশিক্ষকতা, হস্তশিল্প, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অথবা, এনজিও-তে কর্মরত ছিলেন। ফলে, চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা বেশ উদ্বিগ্ন।
এমনিতেই উচ্চশিক্ষা, শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ, কাজের সুযোগ এবং আয়- এসব দিক থেকে বাংলাদেশের নারীরা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে আছেন। তার উপরে করোনাভাইরাসের ধাক্কা এই অবস্থার আরো অবনতি ঘটাতে পারে। উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হলে নারী ক্ষমতায়নের যে ধারা বিদ্যমান ছিলো, তা-ও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
করোনা মহামারি সকলের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। তরুণ-তরুণীরা জীবন ও জীবিকা সংক্রান্ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, লকডাউনের সময় থেকে তরুণ-তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তা সত্বেও জরিপ অনুযায়ী প্রথম লকডাউনের সময়ে ঘিরে থাকা বিষণ্ণতা এবং উদ্বিগ্নতা ১২ শতাংশ তরুণ এবং এক-পঞ্চমাংশ তরুণীদের মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতেও বিরাজমান।
বিআইজিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, মহামারির কারণে নারী-পুরুষের মাঝে সৃষ্ট অসমতা যত দিন যাচ্ছে তত স্পষ্ট হচ্ছে এবং একথা তরুন-তরুণীদের ক্ষেত্রেও একই। যা খুবই চিন্তার ব্যাপার।
এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তার প্রভাব পড়েছে তরুণ-তরুণীদের উপরে। স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হয়েছিলো, শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেকেই নানা প্রশিক্ষণ নেবেন, বিশেষ করে অনলাইনে। জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী মহামারীকালীন সময়ে নতুন প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা জানিয়েছেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, মহামারিতে মানবসম্পদ তৈরির জায়গায় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা এবং শিক্ষার বিকল্প উপায় না থাকার ফলাফল দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে এবং তারুণ্যের আর্থিক স্বচ্ছলতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশে ইউএনএফপিএ-র ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার- অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ইয়ুথ ইউনিট এবং ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট ডঃ মুহম্মদ মুনির হোসাইন বলেন, ইউএনএফপিএ-র কর্মসূচি থেকে দেখা গেছে তরুণ-তরুণীদের মাঝে দক্ষতাবৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সে চাহিদা মেটাতে সুযোগ ও সক্ষমতা তৈরি করা প্রয়োজন।
তার সাথে একমত প্রকাশ করে ব্র্যাকের স্কিলস ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রামের হেড অফ অপারেশানস জয়দীপ সিনহা রায় বলেন, অনলাইনের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করাটা বেশি চ্যালেঞ্জিং।
বিআইজিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা/পরিচালনা করেন। অনলাইনে এ সময় বিশিষ্ট গবেষক, উন্নয়ন কর্মী এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
ইউকে ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) সহযোগিতায় এবং ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (আইডিএস) উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্লাটফর্ম কোভিড কালেকটিভের অংশ হিসেবে এই গবেষণাটি সম্পন্ন হয়েছে।