‘ভ্যাক্সিন কিনতে অর্থ নয়, সমন্বয়হীনতা বড় সমস্যা’

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের ওয়েবিনার

বিশ্বে ৩০ লক্ষ মানুষকে ভ্যক্সিন দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত বড় কোন সমস্যা দেখা দেয় নি। আসছে ফেব্রুয়ারিতে দেশের ২৫ লক্ষ মানুষের জন্য ৫০ লক্ষ ভ্যাক্সিন পাওয়া যাবে আশা রেখে জানুয়ারির মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্নের চিন্তা রয়েছে সরকারের। বাংলাদেশে ভুয়া ভ্যাক্সিন বিক্রি হবার আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভ্যাক্সিন দেয়ার জন্য প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক নিতে হবে। তাদের একঘন্টার অনলাইন প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই প্রশিক্ষিত করা সম্ভব। কে কার আগে ভ্যাক্সিন পাবে তা নির্ধারণ-ই বড় চ্যালেঞ্জ। ভ্যাক্সিন কিনতে অর্থও নয়, সমন্বয়হীনতা বড় সমস্যা। ভ্যাক্সিন প্রদানের ক্ষেত্রেও অব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র গাইডলাইন অনুসরণ করাই উত্তম।

২৭ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন বিতরণে বিশ্ব ও বাংলাদেশের অবস্থান’ শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকরা এসব মতামত দেন। ওয়েবিনারটিতে আলোচক হিসেবে অংশ নেন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, যুক্তরাজ্যের লিস্টার হসপিটালের জিপি রেজিস্ট্রার ডা. সালমা হাসান এবং বাংলাদেশ পোস্টের বিশেষ প্রতিনিধি ডা. নুরুল ইসলাম হাসিব। কানাডার টরন্টো থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর উন্নয়ন অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক শামীম আহমেদ।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে ফাইজারের করোনা ভ্যাক্সিন গ্রহণ করা ডা. সালমা শুরুতেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে এরকম একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে জানান, ভ্যাক্সিন গ্রহণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া হতে পারে জেনেও তিনি তা নিয়েছেন। তার ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন গ্রহণের দিন হাল্কা হাতব্যথা এবং পরদিন ক্লান্তি অনুভূত হয়েছিল৷ কিন্তু এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এরপর আর কোন সমস্যা দেখা যায় নি।

সঞ্চালক শামীম জানান, এখন পর্যন্ত বিশ্বে ৩০ লক্ষ মানুষকে ভ্যক্সিন দেয়া হলেও তেমন বড় কোন সমস্যা দেখা দেয় নি। সামান্য কিছু অ্যালার্জিক রিএকশন হয়েছে যেটা যে কোন চিকিৎসার ক্ষেত্রেই হতে পারে। কানাডায় শুধু যেসব মানুষ ভ্যাক্সিন নিতে ইচ্ছুক, তাদেরই তা দেয়া হবে। কানাডা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে স্বাস্থ্যকর্মী এবং বয়স্ক সহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা লোকজনই এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। ব্যতিক্রম বাংলাদেশে। এখানে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি সহ অনেকেই।

সারা বিশ্বে যারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের সাথে বাংলাদেশে যারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের মধ্যে কোন তফাত রয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে ডা. নুরুল বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা ফ্রন্টলাইনার তাদেরকেই ভ্যাক্সিন দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ২৫ লক্ষ মানুষের জন্য ৫০ লক্ষ ভ্যাক্সিন পাওয়া যাবে আশা রেখে জানুয়ারির মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্নের চিন্তা রয়েছে। অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিন এখনো অনুমোদন না পেলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ এই ভ্যাক্সিন আনার পরিকল্পনাই করেছে।

ডা. সালমা বলেন, করোনাকালে স্বাস্থ্যকর্মীদের সংকট দেখা দেয়ায় যুক্তরাজ্যে ভ্যাক্সিন দেয়ার জন্য হাসপাতাল, কমিউনিটি সেন্টারের রিসিপশনিষ্ট, সেক্রেটারিদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে মন্তব্য করে ব্যারিস্টার শামীম বলেন, এটা রাজনীতি করার বিষয় নয়। বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্যবিদ, স্বাস্থ্যকর্মী, রাজনীতিবিদ সবার কাছ থেকে মতামত নিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। কারণ করোনাকালে শুধু সমন্বয়ের অভাবে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি বিতরণ করা যায় নি। এখন পর্যন্ত সবার জন্য হাসপাতালে অক্সিজেন নিশ্চিত করা যায় নি। তদ্রুপ ভ্যাক্সিন প্রদানের ক্ষেত্রেও অব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে ভুয়া ভ্যাক্সিন বিক্রি হবার আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রাথমিকভাবে ৫০ লক্ষ ভ্যাক্সিন দেয়ার মতো জনশক্তি বিদ্যমান কিনা সেটা বড় প্রশ্ন৷ আর ভ্যাক্সিন পাওয়ার অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) গাইডলাইন দিতে পারে। এটাই সবচেয়ে ভালো হবে। না হলে সরকারকে ব্যর্থতার জন্য রাজনৈতিক দায় নিতে হবে।

তিনি জানান, সরকার উপজেলা তথা স্থানীয় পর্যায়ে যোগাযোগ যথেষ্ট কার্যকরভাবে করতে পারছে না। তার নির্বাচনী এলাকায় ৩ লক্ষ ৯২ হাজার ভোটার, সে হিসেবে জনসংখ্যা হয়তো ৮ লক্ষের মতো। কিন্তু সর্বশেষ জরিপে জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে মাত্র ৪ লক্ষ। সুতরাং ভ্যাক্সিন দেবার ক্ষেত্রে কোন জরিপ ব্যবহার করা হবে তা নিয়েও সংশয় আছে। তাছাড়া নিজ এলাকার জনগণ কিভাবে বা কবে ভ্যাক্সিন পাবে তিনি এখনও এ সংক্রান্ত কোন পরিকল্পনার ব্যাপারে অবগত নন।

তিনি ‘ভ্যাক্সিন ডিপ্লোম্যাসি’ এবং ‘ভ্যাক্সিন জাস্টিস’ এ দুই ধারণার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, স্বাস্থ্যকর্মী এবং করোনা রোগীদের সরাসরি চিকিৎসা দিচ্ছে এমন ব্যক্তিদেরই আগে ভ্যাক্সিন পাওয়া উচিৎ, সংসদ সদস্য এমনকি প্রশাসনের লোকজনেরও আগে। তিনি বলেন, শুরুতে শুধু নকল মাস্কের জন্য অনেক স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ছিল।

ডা. সালমা বলেন, ভ্যাক্সিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের তালিকা সারা পৃথিবীর জন্য এক ধরনের আর বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন ধরনের তা হতে পারে না। ফ্রন্টলাইন কর্মীদের সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হতে পারে না।

তিনি জানান, ফ্রন্টলাইনের তালিকায় বাংলাদেশে যেভাবে চিকিৎসা সেবার বাইরের পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা হচ্ছে, সেটা তাকে হতাশ করে। চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িত ও বৃদ্ধদের আগে ভ্যাক্সিন দিতে হবে। ভ্যাক্সিন দেয়ার জন্য প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক নিতে হবে। কারণ করোনার ভ্যাক্সিন দেয়া খুব কঠিন কাজ নয়। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া খুব কঠিন হবে না। তাদের একঘন্টার অনলাইন প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই প্রশিক্ষিত করা সম্ভব। যুক্তরাজ্যেও তাই করা হয়েছে।

ওয়েবিনারে করা দর্শকের এক প্রশ্নের জবাবে ডা. নুরুল জানান, বাংলাদেশে করোনার ভ্যাক্সিন দেয়ার ক্ষেত্রে জনবল কোন বড় সমস্যা নয়। ইপিআই এর অধীনে বাচ্চাদের নিয়মিত টিকা প্রদান করা হচ্ছে এবং সেটা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পুশ করেই।

তিনি বলেন, কে কার আগে ভ্যাক্সিন পাবে সেটা নিয়ে একটা বড় সমস্যা দেখা যেতে পারে। এটাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে দেশে বিভিন্ন স্তরে সরকার কমিটি করেছে। ন্যশনাল গাইডলাইনেও বিস্তারিত আছে। ফ্রন্টলাইন কর্মী মানে শুধু চিকিৎসক নয়। যিনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করেন তিনিও ফ্রন্টলাইন কর্মী।

বিশ্বের অনেক জায়গায় করোনার ভ্যক্সিন নিতে মানুষ অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন আরেক দর্শকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বাংলাদেশে তেমন কিছু দেখা যায় নি। ভ্যাক্সিন কিনতে অর্থও কোন বড় সমস্যা নয়। তবে তিনি মনে করেন, সমন্বয়হীনতা একটি বড় সমস্যা। সমন্বয় না করা গেলে এসব উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারেন। সেজন্য শুরুতে দেখা গিয়েছিল সামান্য অক্সিজেনও পাওয়া যাচ্ছে না।

ব্যারিস্টার শামীম বলেন, নীতিমালা প্রনয়ণে অবশ্যই সংসদ সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ রাজনীতিবিদরা জনগণের সাথে সম্পর্কযুক্ত। চিকিৎসকদের জন্য আলাদা ক্যাডার সার্ভিস থাকা উচিত। তাহলে সচিবও হবেন চিকিৎসকদের মধ্য থেকে। পিপিই’র মতো ভ্যাক্সিনে কারা অগ্রাধিকার পাবেন তা নিয়েও রাজনীতি করা হচ্ছে। যেটা দেশকে একটা খারাপ জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। সবার আগে সব স্বাস্থ্যকর্মীদের ভ্যাক্সিন দিতে হবে।

সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানিয়ে সঞ্চালক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম কর্তৃক নিয়মিতভাবে আয়োজিত ওয়েবিনারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

Comments (0)
Add Comment