করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর প্রস্তুতি থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক দূরে। সেই সাথে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে বাংলাদেশ পুরোপুরি ব্যর্থ। শুধু ‘ভ্যাকসিনেশন’ নিয়ে কাজ করা লোকজন নয়, বেসরকারি স্বাস্থ্য কর্মী এবং ভ্যাকসিন নিয়ে জানাশোনা লোকজনদেরও কাজে লাগাতে হবে।
করোনা মোকাবেলাকে যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করার মতোই মনে করেন দেশের বিশিষ্ট গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
গত রাতে (২০ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন: বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব মতামত দেন।
এতে অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন আইইডিসিআরএর ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন, বিএসএমএমইউ এর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মােঃ সায়েদুর রহমান এবং আয়ারল্যান্ড থেকে ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিন এর ট্রান্সনেশনাল রিসার্চ ম্যানেজার ড. আরমান রহমান।
কম্বোডিয়া থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র হেলথ স্পেশালিস্ট এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক এই আয়োজন করে আসছে।
সূচনা বক্তব্যে ড. আরমান বলেন, ভ্যাকসিনের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কতোদিন থাকবে সেটা বলার সময় এখনো আসে নি। বিজ্ঞানীদের ধারণা সেটা ৯ মাস থেকে ১ বছর হবে। কোন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতোদিন সেটা নিয়ে সব দেশই হিসেব কষছে। মডার্নার ভ্যাকসিন একটি সম্ভাব্য ভালো ভ্যাকসিন হতে পারে, যেটা ইতিমিধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে এরকম একটি অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে আয়োজন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ড. মুশতাক জানান, একটি খসড়া করা হয়েছে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন আসলে কারা সেটা আগে পাবেন। প্রথমেই থাকবেন সব স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীরা, সংখ্যাটা ৪,৬৩,৩৬১। এরপর বেসরকারি হাসপাতাল, এনজিও থেকে প্রায় সাত লক্ষ। এরপর যারা সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে আসেন, যেমন বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ক্লিনিক্যাল স্টাফ, সংখ্যাটা দেড় লক্ষ। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধারা দুই লক্ষ দশ হাজার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সদস্য যারা ফ্রন্টলাইনার, ৫,৪৬,৬১৯। সশস্ত্র বাহিনী, র্যাব, বিজিবি ৩,০৯,৭১৩। ডিসি, ইউএনও সহ আমলা ৫ হাজারের মতো। ফ্রন্টলাইনার সাংবাদিক ৫০ হাজারের মতো। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ৬৮,২৯৮। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কর্মচারী ও অন্যান্য দেড় লাখের মতো। ঈমাম, ধর্ম যাজক ইত্যাদি ৫ লক্ষ ৮৬ হাজার। দাফন কাফনে যুক্ত ৭৫ হাজার৷ ওয়াসা, ডেসা, ফায়ার সার্ভিস, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কর্মী ৩ লক্ষ ৫০ হাজার। বিভিন্ন বন্দরের কর্মী দেড় লক্ষ। বিদেশে গমনেচ্ছুক ১ লক্ষ ২০ হাজার। জেলা উপজেলায় বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সাড়ে তিন লাখ। ব্যাংকে চাকরিজীবী যারা সরাসরি ডেস্কে কাজ করেন ১ লক্ষ ৯৭ হাজার। রোগী যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম (ক্রনিক ডিজিজ সহ) এমন ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বাস্থ্যকর্মী ২৬,২৭১ এবং অন্যান্য। এই ৫১ লক্ষ ৮৪ হাজার ২৮২ জন মানুষ দেশে শতকরা ৩ ভাগ ভ্যাকসিন আসলে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবেন দুই ডোজ করে৷ এরপর ষাট বছরের বেশি বয়স্ক লোকজন ১২ লাখ ৯৬ হাজার, শতকরা ৭ ভাগ ভ্যাকসিন আসলে সেটা পাবেন।
ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রার প্রয়োজন। মডার্নার ক্ষেত্রে তা মাইন্স ২০ ডিগ্রি। মাইনাস ১৫ থেকে মাইনাস ২৫ হলে বাংলাদেশের কিছুটা সক্ষমতা থাকলেও মাইনাস ৭০ এর ক্ষেত্রে একেবারেই সক্ষমতা নেই।
আইইডিসিআর, সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সারা বছরই অজানা মহামারী আসবে এমন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। যখন করোনা মারাত্মক রূপ নিলো তখন ডিজি হেলথ এদের শক্তিশালী না করে ভাড়া করা লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ফলে জেকেজি, শাহেদদের মতো প্রতারকরা ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের কাজ যেহেতু ইপিআই করে সুতরাং তাদের এ দায়িত্বে না রেখে ভাড়া করা লোকদের দিলে সমস্যা আরো বাড়বে।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অধ্যাপক ডা. সায়েদুর বলেন, দেশের সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের উপর যদি জনগণের আস্থা না থাকে তাহলে মহামারী মোকাবেলা দূরে থাক, সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা দেয়াই সম্ভব নয়। এই মুহুর্তে দেশে আস্থার সংকট রয়েছে। এটা মহামারী কেন্দ্রিক নয়, আগেও ছিল, করোনাকালে স্পষ্ট হয়েছে মাত্র। প্রতি মাসে ২৫ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া গেলেও বছরে ৩ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে। ১৩ কোটি মানুষকে দিতে হলে প্রয়োজন হবে সাড়ে ৪ বছর। আর ভ্যাকসিনগুলোর গড় কার্যকারিতা ধরা হচ্ছে ৯ মাস থেকে ১ বছর। এভাবে হলেতো সারাজীবনেও সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। আমাদের যদি প্রতি মাসে দুই কোটি ভ্যাকসিন দেয়ার সক্ষমতা না থাকে তাহলে কখনোই সব মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে পারবো না।
ড. মুশতাক এবং অন্যরাও অধ্যাপক সায়েদুরের যুক্তির সাথে একাত্মতা পোষণ করেন। ডক্টর মুশতাক বলেন, সমস্যা সমাধানে জনবল এবং সক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে।
করোনা মোকাবেলাকে বিশ্বযুদ্ধ বা যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা মোকাবেলার সাথে তুলনা করে অধ্যাপক ডা. সায়েদুর বলেন, কানাডা, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র বিশাল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটা এখন আর শুধু স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক জেনারেলরা ভ্যাকসিনের দায়িত্বে আছেন। বাংলাদেশকেও সেভাবে এগুতে হবে। শুধু এনজিও নয়, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আর ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা মাস্ক পড়া সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে আলোচনা যেনো ভুলেই গেছি। মাস্ক পড়া, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, আইসোলেশন ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে ১৭ কোটি মানুষকে মূল সমস্যা সমাধানের দিকে নেয়া যায় না।
ড. আরমান বলেন, ইউরোপের সব দেশ নিজেদের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করেছে, পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে কম দামে ভ্যাকসিন পাওয়াও নিশ্চিত করেছে। উন্নত দেশগুলো তাদের নিজেদের নাগরিকদের আগে ভ্যাকসিন না দিয়ে দরিদ্র দেশগুলোকে দেবে এটা আশা করা যায় না। অন্যদিকে কোন ভ্যাকসিন কেমন হবে, সেগুলো কতোদিন সুরক্ষা দেবে, দেয়ার প্রক্রিয়া কি হবে এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, অনেকগুলো ভ্যাকসিন সফল হবার দ্বারপ্রান্তে। এগুলো নিয়ে নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে গণমাধ্যম। তাহলে কেন আমরা শুধু একটি ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে আছি? শুধু ‘ভ্যাকসিনেশন’ নিয়ে কাজ করা লোকজন নয়, ভ্যাকসিন নিয়ে জানাশোনা লোকজনদেরও কাজে লাগাতে হবে।
সঞ্চালক ড. জিয়া জানান, বাংলাদেশ থেকেও দরিদ্র দেশ কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ৫ দিনের মধ্যে নাগরিকদের কাছ থেকে ভ্যাকসিন কেনার জন্য ৪০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছেন।
কোভ্যাক্স এর বাইরেও বিভিন্ন দেশের সাথে ভ্যাকসিন পেতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলছে। কারণ কেবল একটি দেশ বা কোম্পানির সাথে চুক্তি করে বসে থাকলে চুক্তিভঙ্গের আশংকা থেকে যায়। তাছাড়া সেক্ষেত্রে একটি কোম্পানি ভ্যাকসিন সরবরাহে ব্যর্থ হলে অন্যটি থেকে পাবার সম্ভাবনা থাকে।
অধ্যাপক ডা. সায়েদুর জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো গড়ে তিন থেকে চারটি কোম্পানির কাছে ভ্যাকসিন বায়না করে রেখেছে। নাগরিকদের সংখ্যার দ্বিগুণ থেকে দশগুণও অনেকে বায়না করে রেখেছে। অনেক নাম না জানা কোম্পানির সাথে অনেক দেশ চুক্তি করে রেখেছে, যা হয়তো আমরা জানিও না। আমাদেরকে যেভাবেই হোক ৩০ কোটি ভ্যাকসিন জোগাড় করতে হবে। বড় কোম্পানিগুলোর ভ্যাক্সিনের ফেস থ্রি ট্রায়াল বাংলাদেশে করার সুযোগ দিয়ে আমরা তাদের কাছ থেকে ভ্যাকসিন পেতে উচ্চস্বরে কথা বলতে পারতাম। এখনও সেই সুযোগ রয়েছে।
সব মিলিয়ে ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ সঠিক পথে নেই মন্তব্য করে ড. আরমান বলেন, একটিমাত্র ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে থাকা হচ্ছে।যদিও ৪০ টির মতো ভ্যাকসিন সাফল্যের পথে। বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে COVID -19 ভ্যাকসিন যোগানদাতাদের নেটওয়ার্ক বাড়াতে হবে এবং এর জন্য প্রয়োজন এগ্রেসিভ কূটনৈতিক তৎপরতা।
করোকালেও চুরি করে ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের চেষ্টায় প্রশাসনের ভেতরে এবং বাইরে, রাজনৈতিক কর্মীদের একাংশের মধ্যে দুর্নীতি মারাত্মক হতাশ করেছে বলে মত দেন ড. মুশতাক।