ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে পরিচিত ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন লেখক, সাবেক বিবিসি সাংবাদিক, লণ্ডনে স্প্রেক্ট্রাম রেডিওর প্রতিষ্ঠাতা শফিক রেহমান। রাজধানীর তেজগাঁয়ে তার অফিসের (যায়যায়দিন) সামনে একটি সড়কের নামকরণও করেন ‘লাভ লেন’ বা ‘লাভ রোড’। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণায় একমাত্র তিনিই সরব ছিলেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’। আর এখন বাংলাদেশে এ দিবস পালিত হয় ব্যাপক পরিসরে, নানা আয়োজনে।
মাল্টিনিউজটোয়েন্টিফোর বার্তা সম্পাদক তারিক চয়নের সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি জানালেন, এ দিবস শুধু প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য- ধারণাটি ভুল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা-সম্প্রীতির কথা মাথায় রেখে তিনি দিবসটির প্রচলন করেন, “আমরা যারা সমাজের উপরের তলার মানুষ, আমরা যারা লিখি, তারা হয়তো অনেকেই বুঝি না, আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনে কিভাবে প্রেম আসে। তাই ভেবে আমি ঠিক করলাম বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসার মানে বোঝাতে হবে।“
তা কিভাবে মাথায় আসলো বিষয়টি এ প্রশ্নের উত্তরে পুরনো স্মৃতিচারণ করে জানালেন, লেখালেখির কারণে তাকে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত লন্ডনে নির্বাসিত থাকতে হয়েছিল। সে সময় তিনি সেখানে ‘ভালোবাসা দিবস’ উদযাপন হতে দেখেছেন। লন্ডনে নব্বইয়ের দশকে খুব বেশি পালিত হওয়া শুরু হয় ভ্যালেন্টাইন ডে। বাণিজ্যিক কারণে হলেও সেখানকার স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকারা দিবসটিকে সাদরে গ্রহণ করেন। ওই সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বাংলাদেশে ফিরে আসার পর দিনটিকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেবেন। কারণ ভ্যালেন্টাইন ডের মধ্যে ভালোবাসার বাণী খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। আর ঘন বসতির বাংলাদেশে ভালোবাসাটা অনেক বেশি দরকার। সুসম্পর্ক, সহাবস্থান গড়ে ওঠা জরুরি।
তবে বাংলাদেশে শুরু করার আগে লন্ডনে প্রচলিত ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ থেকে শুরুর ‘সেইন্ট’ শব্দটি ধর্মীয় কারণে বাদ দেয়া হয়। এটি ‘ভালোবাসার দিন’ হিসেবে প্রচার শুরু হয় তৎকালীন যায়যায়দিন পত্রিকায়। সেই সঙ্গে দিনটিকে শুধু স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ভাই-বোন, বাবা-মা-সন্তানদের মধ্যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও যুক্ত করা হয়। বলা হতো, ‘এ দিনে মায়ের প্রতি ভালোবাসা দেখাও। অন্তত এক কাপ চা হলেও বানিয়ে মাকে খাওয়াও।’ তখন ওই পত্রিকায় ‘ভালোবাসার দিন’ নিয়ে লেখাও আহ্বান করেন সম্পাদক শফিক রেহমান। বিপুলসংখ্যক পাঠক নিজ নিজ ভালোবাসার গল্প লিখে চিঠি পাঠায় পত্রিকাটিতে। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে ব্যাপক আকারে ১৪ জানুয়ারিকে ‘ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু হয় বাংলাদেশে।
ভালোবাসা দিবস পালন শুরুর পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার একটি সড়কের নাম ‘লাভ লেন’ রাখতে সক্ষম হয়েছেন শফিক রেহমান। আসলে তিনি নিজে যখন প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন তখন চট্টগ্রামে ডিসি হিলের উল্টোদিকে ছোট্ট একটি রাস্তার নাম ছিল লাভ লেন। এই লেনের শুরুতে পানের দোকান ছিল। প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানে এসে পান খেত। পানের আকৃতিও ছিল হৃদয়ের মতো। শফিক রেহমান যখন যায়যায়দিনের প্লট বুকিং দেন তখন সেই রাস্তাগুলোর কোনো নাম ছিল না। এ সুযোগে তৎকালীন নগরপিতার মাধ্যমে এলাকাবাসীর আগ্রহে তেজগাঁওয়ের এ রাস্তার নাম রাখা হয় ‘লাভ লেন’।
মাল্টিনিউজটোয়েন্টিফোর পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার কাছে কিনা জানতে চাইলে তার হাসিমাখা কন্ঠ, “এই ভালোবাসা দিবস শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই নয়, সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া উচিত। বাবা-মার সঙ্গে ছেলে-মেয়ের; দাদা-দাদীর সঙ্গে নাতি-নাতনির; এমনকি বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভাড়াটের। আসলে আমি চেয়েছিলাম, সব ধরণের ভালোবাসার সম্পর্ক-ই যেন এই ভালোবাসা দিবসে স্মরণ করা হয়। আর এখন তো ১৪ই ফেব্রুয়ারীতে বহুলোক বিয়েও করছে। এই দিনটি বাংলাদেশে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, অনেক চাষী বিক্রি করছে কোটি কোটি টাকার ফুল।”