ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস রচনার উপাদান প্রচুর। ভারতে বিভিন্ন মুসলিম রাজবংশের আমলে রচিত সমসাময়িক ইতিহাস ও ঐতিহাসিক সাহিত্য থেকে মুসলিম শাসনামলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাদির একটা সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি চয়ন করা সহজ। ভারতে মুসলিম শাসনামলে ইতিহাস রচনায় মূলত চারটি উৎস থেকে উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছে। যথা—
ক. রাজকীয় দলিলপত্র।
খ. মুদ্রা ও স্মৃতিস্তম্ভ।
গ. বিদেশি বণিক ও পর্যটকদের বিবরণ।
ঘ. ইতিহাস ও ঐতিহাসিক সাহিত্য।
রাজকীয় দলিলপত্র : ভারতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুসলিম রাজবংশ শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। এ দেশে মুসলমানদের আগমন-পরবর্তী বিভিন্ন রাজবংশের রাষ্ট্রীয় দলিলপত্র ইসলামের ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এসব উৎস থেকে সে যুগের ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছে।
মুদ্রা ও স্মৃতিস্তম্ভ : মুসলিম যুগের মুদ্রা ও স্মৃতিস্তম্ভের বহু নিদর্শন আজও বিদ্যমান। সে যুগের প্রাপ্ত মুদ্রা থেকে সুলতানি ও মোগল শাসনামলের বহু তথ্য পাওয়া যায়। সন-তারিখ সংবলিত মুদ্রাসমূহের মাধ্যমে বিভিন্ন বংশের রাজত্বকাল নিরূপণ করা যায়। কখনো কখনো সেগুলো থেকে সম্রাটদের নাম এবং পরোক্ষভাবে সে সময়ের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অবস্থাদিও জানা যায়। স্মৃতিস্তম্ভসমূহ সমসাময়িক শাসনবর্গের ব্যক্তিগত রুচি ও আর্থিক সমৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে।
বিদেশি বণিক ও পর্যটকদের বিবরণ : ভারত উপমহাদেশে মুসলিম ইতিহাসের মূল্যবান উৎস হলো বিদেশি বণিক ও পর্যটকদের বিবরণী। প্রাক-মোগল যুগে আগমন পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্ত সংবলিত গ্রন্থ ‘রেহলা’ সুলতানি আমলের ইতিহাসের এক অনন্য উপাদান। চীনা পর্যটক মা হুয়ান পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ সফর করে তৎকালীন বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার এক তথ্যবহুল বিবরণী রেখে গেছেন। সুলতানি আমলে আগত পর্যটকদের মধ্যে নিকোলো কন্টি, আবদুর রাজ্জাক ও মার্কোপোলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ষষ্ঠদশ শতাব্দী থেকে একাধিক ইউরোপীয় পর্যটক ভারতে এসে তাদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। র্যালফ ফিচ, পার্চাস, টেরি, টেভারনিয়ার, বার্নিয়ার, মানুচি প্রমুখ পর্যটকের গ্রন্থ থেকে মোগল শাসনামলের মূল্যবান ইতিহাস পাওয়া যায়।
ইতিহাস ও ঐতিহাসিক সাহিত্য : ভারত উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাসের সমৃদ্ধ উৎস হলো অজস্র ইতিহাস গ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সাহিত্য। নিম্নে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাদির বিবরণ প্রদত্ত হলো। যেমন—
চাচনামা : মূলত আরবি ভাষায় রচিত এই গ্রন্থটির ফারসি অনুবাদ করেন আলী ইবনে হামিদ কুফি (১২১৬-১৭ খ্রিস্টাব্দ)। এই গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বাপর সিন্ধুদেশের অবস্থাদি ও সিন্ধু বিজয় কাহিনি বিধৃত হয়েছে। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণীসংবলিত প্রাথমিক গ্রন্থ হিসেবে ‘চাচনামা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তারিখে সিন্ধ : মির মুহাম্মদ মাসুম কর্তৃক রচিত ‘তারিখে সিন্ধ’ [রচনাকাল ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ] গ্রন্থে আরবদের সিন্ধু অভিযানের সময় থেকে সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ আছে।
কিতাবুল ইয়েমেনি : ‘কিতাবুল ইয়েমেনি’ গ্রন্থের রচয়িতা আবু নাসের ইবনে উতবি গজনির সুলতান সবুক্তগিন ও সুলতান মাহমুদের রাজত্বকাল থেকে ১০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন।
তারিখুল হিন্দ : মধ্যযুগের মূল্যবান রচনা হলো আলবেরুনি [৯৭০-১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ] রচিত ‘তারিখুল হিন্দ’। আলবেরুনি সুলতান মাহমুদের সঙ্গে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর রচিত তারিখুল হিন্দ থেকে একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভারতের ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও দর্শন সম্বন্ধে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের প্রাক্কালে ভারতের সার্বিক অবস্থার এক তথ্যবহুল বিবরণও এতে লিপিবদ্ধ হয়।
তাজুল মাসির : হাসান নিজামি রচিত ‘তাজুল মাসির’ গ্রন্থে ১১৯২ থেকে ১২২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলির বিবরণ আছে। এ কারণে এটিকে কুতুবুদ্দিন আইবেক ও ইলতুতমিশের রাজত্বকালের প্রথম দিকের প্রাথমিক গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হয়।
তাবাকাতে নাসিরি : ‘তাবাকাতে নাসিরি’ গ্রন্থের রচয়িতা মিনহাজুস সিরাজ। এই গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য হলো, এতে মুহাম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লির তুর্কি সালতানাতের ধারাবাহিক ইতিহাস বিধৃত হয়েছে এই গ্রন্থে।
খাজায়েনুল ফুতুহ : ঐতিহাসিক আমির খসরু রচিত ‘খাজায়েনুল ফুতুহ’ মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই গ্রন্থে আলাউদ্দিন খিলজির দাক্ষিণাত্য, বরঙ্গল, মেবার অভিযান, তাঁর প্রশাসনিক সংস্কার, মোগল আক্রমণ প্রভৃতি বিষয়ের বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। খিলজি ও মোগল রাজবংশের ইতিহাসের জন্য এই গ্রন্থখানি খুবই মূল্যবান।
তারিখে ফিরোজ শাহী : উপমহাদেশের ইসলামী ইতিহাসের ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত তারিখে ‘ফিরোজ শাহী’ গ্রন্থটি এক অমূল্য সম্পদ। সুলতান বলবনের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বের প্রথম ছয় বছরের বিশদ ঘটনাবলি এই গ্রন্থে বর্ণিত আছে। আলাউদ্দিন খিলজি ও মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজস্ব সংস্কারের ঐতিহাসিক বিবরণ এতে সন্নিবেশিত হয়েছে।
ফুতুহুস সালাতিন : ঐতিহাসিক খাজা আব্দুল্লাহ মালিক রচিত ‘ফুতুহুস সালাতিন’ ভারতীয় মুসলিম ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই গ্রন্থে গজনীর সুলতান মাহমুদের সময় থেকে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকাল পর্যন্ত ধারাবাহিক ইতিহাস সন্নিবেশিত হয়েছে ।
মোগল যুগে রচিত গ্রন্থাদি : মোগল শাসনমলে মুসলিম ভারতের ইতিহাসনির্ভর অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়। সম্রাট বাবর, হুমায়ুন, জাহাঙ্গীর প্রমুখ সম্রাট তাঁদের আত্মজীবনীমূলক বহু ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া আবুল ফজল রচিত ‘আইনে আকবরী ও আকবরনামা’, তিনজন ঐতিহাসিকের সমন্বয়ে রচিত ’বাদশাহনামা’, ‘নাসিরে আলমগীরী’ ও কাজি খাঁ রচিত ‘মুন্তাখাবুল লুবাব’ এবং বাদায়ুনি রচিত ‘মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ’ ইত্যাদি মোগল আমলের উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক উৎস গ্রন্থ।
সাহিত্য : ভারতের মুসলিম শাসনামলের ইতিহাস সমকালীন বিভিন্ন সাহিত্যগ্রন্থে বিধৃত হয়েছে। আমির খসরু রচিত ‘খাজায়েল ফুতুহ’ এবং মুহাম্মদ জায়সি রচিত ‘পদ্মাভত’ (Padmavat) গ্রন্থদ্বয়ে বহু মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্য বর্ণিত হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, ৭১২ খ্রিস্টাব্দে রাজা দাহিরের পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। এরপর থেকে সোয়া এক সহস্রাব্দ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসনামলের সুদীর্ঘ ইতিহাস বিবিধ উৎস থেকে সংগ্রহ করা যায়। এসব উৎসের অনেক অনুদঘাটিত তথ্য প্রকাশিত হলে ভারতে মুসলমানদের আরো বিস্তারিত ইতিহাস জানা যাবে।