ভারতবর্ষের অমুসলিমদের জাতিগত ভেদাভেদ এবং উঁচু-নিচু জাত-পাতের প্রথা থাকা সত্ত্বেও এ অঞ্চলের রাজা-বাদশাহ ও অধিবাসীরা মুসলমানদের সঙ্গে সম্প্রীতির বন্ধতে আবদ্ধ হয়েছিল। তারা মুসলমানদের খলিফাকে গোটা বিশ্বের রাজাদের মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করত। প্রখ্যাত পর্যটক বণিক সুলায়মান (মৃত্যু : ২৩৭ হিজরি) উল্লেখ করেন যে ভারত ও চীনের জনগণ এ ধারণা পোষণ করত যে তৎকালীন বিশ্বে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন চারজন : প্রথমজন হলেন আরবের রাজা (খলিফাতুল মুসলিমিন)। তাদের ধারণামতে, তিনি হলেন এঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা, তিনিই সবচেয়ে সুন্দর ও তাঁর ধন-সম্পদ সবচেয়ে বেশি। আরবের রাজার পরে চীনের রাজা নিজেকে গণ্য করতেন। তারপর রোমের রাজা এবং তারপর ভারতের রাজা। মুসলিম খলিফাদের সম্পর্কে এই সুধারণা হিন্দুস্তানের রাজাদের পাশাপাশি প্রজাদের মধ্যেও প্রসিদ্ধ ছিল। (বণিক সুলায়মানের ভ্রমণকাহিনি পৃষ্ঠা ২৬, খেলাফতে আব্বাসিয়া আওর হিন্দুস্তান-কাজি আতহার মোবারকপুরি, পৃষ্ঠা ৩০৬-এর বরাতে)
প্রাচীনকাল থেকেই সরণদীপের জনগণ আরব মুসলমানদের ভালোবাসত। তারা নবী যুগেই একজন ধর্মীয় নেতাকে মদিনায় পাঠায় এবং তাঁর ভৃত্য এখানে এসে ওমর (রা.)-এর ধর্মীয় জীবনের ঘটনা বর্ণনা করেন। (আজায়েবুল হিন্দ, পৃষ্ঠা ১৫৭, খেলাফতে রাশেদা আওর হিন্দুস্তান-কাজি আতহার মোবারকপুরি, পৃষ্ঠা ২১৯-২২১-এর বরাতে)
তদ্রূপ হিন্দুস্তানের অনেক রাজা উমাইয়া খলিফার কাছে বিভিন্ন উপহারসামগ্রী পাঠিয়ে তাঁদের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করতেন। আব্বাসি শাসনামলেও তদ্রূপ হতো। এটি ছিল মুসলমানদের প্রতি তাঁদের অগাধ ভালোবাসা ও ভক্তির বহিঃপ্রকাশ।
মুসলিমদের প্রতি গুজরাটবাসীর ভক্তি-শ্রদ্ধা
গুজরাটের রাজারা সমগ্র ভারতবর্ষের রাজা-মহারাজাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রতাপশালী ছিলেন। হিন্দুস্তানের অন্য শাসকরা তাঁদের প্রতাপের সামনে মাথা নত করতেন। সেই গুজরাটের রাজারাও আরব মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। পর্যটক বণিক সুলায়মান বলেন, গুজরাটের বালহারা রাজপরিবারের রাজাদের আয়ুষ্কাল দীর্ঘ হতো। কোনো কোনো রাজা ৫০ বছরও শাসন করেছিলেন। তাই সে অঞ্চলের লোকেরা ধারণা করত যে তাদের রাজাদের এই দীর্ঘ আয়ুষ্কাল আরবদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কারণেই হয়েছে। (বণিক সুলায়মানের ভ্রমণকাহিনি, পৃষ্ঠা ২৭, খেলাফতে আব্বাসিয়া আওর হিন্দুস্তান-কাজি আতহার মোবারকপুরি, ৩০৮-এর বরাতে)
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মাসউদি (মৃত্যু : ৩৪৬ হি.), ভূগোলবিদ ইস্তাখরি (মৃত্যু : ৩৪৬ হি.) প্রমুখও আরবদের প্রতি রাজা বলহার ও তাঁর প্রজাদের ভালোবাসা ও ভক্তি সম্পর্কে লিখেছেন এবং বর্ণনা করেছেন যে এখানকার সাধারণ মসজিদ ও জামে মসজিদগুলো মুসলিমদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ থাকত। (মুরুজুজ জাহাব ১/১৭০, মাসালিকুল মামালিক, পৃষ্ঠা ১৭৩)
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ বালাজুরি (মৃত্যু : ২৭৯ হি.) লিখেছেন, যদিও এই অঞ্চলের বাসিন্দা অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তবে মুসলিমরা শহরে বাস করত। আর জামে মসজিদগুলো মুসলিমদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। আব্বাসি খলিফা আবু জাফর মনসুরের শাসনকালে সিন্ধু প্রদেশের গভর্নর হিশাম ইবনে উমর যখন বারিদ (ভারভোট) ও কান্দাহার জয় করেন, ওই বছর সে অঞ্চলে খুব বেশি ফলন হয়। তখন লোকেরা হিশাম ইবনে উমর ও মুসলিম সৈন্যদের সে অঞ্চলে বরকত ও আশীর্বাদের উৎস হিসেবে বিবেচনা করেছিল। (ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৪৩১)
মুসলিমদের ব্যাপারে রাজা রুতবিলের অভিব্যক্তি
উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ ইবনে আব্দুল মালিকের শাসনামলে তাঁর প্রেরিত কর প্রতিনিধিরা বর্তমান আফগানিস্তানের অন্তর্গত বামিয়ানের (তৎকালে আরবরা এটিকে হিন্দুস্তানের অংশ মনে করত) রাজা রুতবিলের কাছে প্রাপ্য কর উত্তোলনের জন্য যান। তখন রাজা রুতবিল বলেন, ‘তোমাদের জাতির ওই লোকেরা কোথায়, যাঁরা আগে আমাদের কাছে আসতেন (রোজার কারণে) শূন্যোদর অবস্থায় এবং নামাজের কারণে কপালে কালো দাগসংবলিত, আর তাঁদের জুতা ছিল খেজুর পাতায় তৈরি?’ প্রতিনিধিরা বললেন : ‘তাঁরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।’ তখন রাজা রুতবিল বললেন, ‘তাঁরা তোমাদের চেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী ও শক্তিতে প্রবলতর ছিলেন, যদিও তোমরা তাঁদের চেয়ে সুদর্শন।’ (ফুতুহুল বুলদান-বালাজুরি, পৃষ্ঠা ৩৮৮)
আসিফানের রাজার ইসলাম গ্রহণ
তৎকালীন হিন্দুস্তানের রাজারা মুসলিম খিলাফতের প্রতিনিধি ও আমিরদের সহযোগিতা করতেন; এমনকি তাঁদের অনেকে ইসলামের সত্যতায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলমান হয়ে যেতেন। ইতিহাসবিদ বালাজুরি লিখেছেন যে আব্বাসি খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর শাসনামলে কাশ্মীর, মুলতান ও কাবুলের মধ্যবর্তী শহর আসিফানের রাজা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী। এখানকার সাধারণ মানুষ মূর্তিপূজক ছিল। একবার রাজার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি মন্দিরের পুরোহিতদের ডেকে এনে বললেন, তাঁরা যেন শিশুটির সুস্থতার জন্য মূর্তির কাছে প্রার্থনা করেন। তাঁরা পরদিন এসে বললেন, ‘আমরা শিশুটির সুস্থতার জন্য অনেক প্রার্থনা করেছি এবং আমাদের মূর্তি প্রার্থনা শুনেছেন।’ কিন্তু ঘটনাক্রমে শিশুটি মারা যায়। তখন রাজা ক্রোধে মন্দিরের মূর্তিটি ভেঙে ফেলে দেন। তারপর বাদশাহ একদল আরব মুসলিম বণিককে ডেকে আনলেন, যাঁরা তাঁর সামনে তাওহিদ ও একত্ববাদের দাওয়াত পেশ করলেন। এতে রাজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। (ফুতুহুল বুলদান, বালাজুরি পৃষ্ঠা ৪৩৩)