ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে জিম্মি প্রান্তিক তাঁতীরা

কেউ ঋণগ্রস্ত, কেউ ছাড়ছেন পেশা

সামান্য নগদ অর্থের বিনিময়ে অনেক তাঁতী তাদের সমিতির নামে বরাদ্দ কোটা (আমদানির পরিমাণ) আগাম বিক্রি করছেন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে। ওই কোটায় সুতা আমদানি করে সিন্ডিকেটের অন্তর্ভূক্ত ব্যবসায়ীরা আবার সাধারণ তাঁতীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করছেন। এতে ঋণগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ দরিদ্র তাঁতীরা। আর ফায়দা লুটছে সিন্ডিকেট সদস্যরা।

সাধারণ ও দরিদ্র তাঁতীরা ঋণের হাত থেকে বাঁচতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অন্যদিকে সিন্ডিকেট চক্রের ব্যবসায়ীরা সরাসরি নিজেদের ব্যবসার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কথা অস্বীকার করলেও বলছেন তাঁতীরা তৃতীয় পক্ষের কাছে জিম্মি। তবে এই তৃতীয় পক্ষ কারা সেটা তাদের জানা নেই।

যেভাবে শুরু এই সিন্ডিকেটের ব্যবসা: সরকার প্রান্তিক তাঁতীদের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড থেকে সহজ শর্তে ঋণসুবিধার ব্যবস্থা করে এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় তাঁত বোর্ড নিবন্ধিত প্রাথমিক তাঁতী সমিতিকে সুতা, রং ও রাসায়নিক আমদানির ব্যবস্থা করে।

অভিযোগ রয়েছে, এ সুযোগে প্রাথমিক তাঁতী সমিতির নামে সুতা, রং ও রাসায়নিক আমদানি করতে থাকেন নারায়ণগঞ্জের সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ফজলুল হক, সুতা ব্যবসায়ী হাজী আব্দুল সাত্তার ও তাদের সহযোগী মো. জহির মিয়া। এরা কেউ তাঁতী বা তাঁতী প্রতিনিধিও নন বা এদের কারও কোনো তাঁত নেই বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অবৈধ আমদানিতে যুক্ত থাকাদের উদ্দেশ্য হলো তাঁতীদের নামে বরাদ্দ করা সুতা করায়ত্ত করা এবং সরকার কর্তৃক জারি করা চেকলিস্ট বাতিল করে অন্য মহলের মাধ্যমে নিজেরা সুতা, রং ও রাসায়নিক আমদানি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে ব্যবসায় বহুগুণ মুনাফা করা।

২০১৮ সালে দেশব্যাপী পরিচালিত তাঁত শুমারি অনুযায়ী দেশে বিদ্যমান ১ লাখ ১৬ হাজার ১১৭টি তাঁত ইউনিটে মোট হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা ২ লাখ ৯০ হাজার ২৮২টি। বর্তমানে এ শিল্পের সঙ্গে তাঁতীসহ প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ লোক নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁতশিল্প থেকে বছরে ৪৭ দশমিক ৪৭৪ কোটি মিটার কাপড় উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী তাঁতশিল্প দেশের বস্ত্র চাহিদার প্রায় ২৮ ভাগ পূরণ করার পাশাপাশি জিডিপিতে অবদান রাখে শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। সাম্প্রতিককালে দেশের তাঁতশিল্পে ধ্বস নেমেছে। একসময় যে তাঁতিদের সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল সে তাঁতীদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। কয়েক বছর ধরে সুতার দাম বাড়ার কারণে অনেকেই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। বাপ দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে কিছু মানুষ এখনও তাঁত বুনে সংসার চালানোর স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা তেমন না থাকায় ঋণের বোঝা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন তারা। বছর দুয়েক আগেও যাদের ২০ থেকে ২৫টি তাঁত ছিল, তাদের তাঁত এখন হাতে গোনা চার-পাঁচটি।

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর নাগবাড়ি ১নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতী সমিতির সভাপতি মো. পারভেজ আহমেদ বলেন, আগে সুতার দাম অনেক কম ছিল এখনর সুতার দাম অনেক বেশি। আমরা প্রান্তিক তাঁতীরা সরকারের কোনো প্রকার সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি না। পাঁচ-সাত বছর আগে একটি চক্র আমাদের সকল প্রান্তিক তাঁতীদের ধোঁকা ও বোকা বানিয়ে সর্বস্ব নিয়ে গেছে। এদের হোতা নারায়ণগঞ্জের সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ফজলুল হক। সমিতির নামে সব কিছু থাকলেও এই চক্রটি এখনো শুল্কের ঋণ শোধ করে নাই। বর্তমানে তাঁত ব্যবসায় আমি ঋণগ্রস্ত ও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আগে তাঁত চলত ২০ থেকে ২৫টি, এখন কোনো রকমে চলছে তিন থেকে চারটা। বলতে গেলে সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতী সমিতির সভাপতি মো. আব্দুল কাদের বলেন, নারায়ণগঞ্জের একটি চক্র ফজলুল হক, হাজী সাত্তার, জহিররা সুতা আমদানীর কথা বলে, কিন্তু তারা কখনোই সঠিকভাবে আমাদের হিসাব দেয় নাই। তাঁত প্রতি মাত্র ৫০০ টাকা করে দিয়েছে। বর্তমানে এমন অবস্থা আমরা নিজেদের করা ঋণগুলোই শোধ করতে পারছি না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি সঠিক সুযোগ সুবিধা দিলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম। তবে ষোলো আনার মধ্যে দুই আনা দিলে হবে না। পাশাপাশি আর এই অপরাধী চক্রকে বিচারের আত্ততায় আনতে পাড়লে প্রান্তিক তাঁতীরা লাভবান হবে।

দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এখনও সক্রিয়: তাঁত বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এই তাঁত শিল্পে সরকারের দেয়া সুবিধার ভাগ নিতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। তাঁত বোর্ডের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীও এর সঙ্গে জড়িত। এই স্বার্থ হাসিল করতে চক্রটি কখনও কখনও সংশ্লিষ্ট পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়েও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেন। বিগত সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছর মেয়াদে চক্রটির সদস্যরা প্রতাপের সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করে স্বার্থসিদ্ধি করে নিয়েছেন।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘমেয়াদী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হলেও এই চক্রটি থেমে নেই। রঙ ও খোলস পাল্টে তারা নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন। তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে তাঁত বোর্ডে থাকা সহযোগীদের পরামর্শে তারা তাঁতীদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নানধরনের ভূয়া-বানোয়াট অভিযোগ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনাসামনি দাঁড় করান। এই চক্রের দৌরাত্মে একদিকে সাধারণ তাঁতীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে অপরদিকে তাঁত বোর্ডের সৎ ও নিরীহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন নিয়মিত।

প্রান্তিক তাঁতীদের দুর্দশা ও সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমদানী করা সুতাগুলো শতভাগ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। তাঁতীদের কাছে টাকা না থাকলে কীভাবে কিনবে। আবার অনেক সময় সুতা কিনতে তৃতীয় পক্ষের কাছে যেতে হয়। তখন এমনিতেও সুতার দাম বেড়ে যায়।

প্রান্তিক তাঁতীদের করা অভিযোগ অস্বীকার করে ফজলুল হক বলেন, আমার নারায়ণগঞ্জের তাঁতীরা ভালো আছে। আমি অন্য এলাকার খবর জানি না। আমি ছোটখাট ব্যবসা করি। অনেকটা দালালির মতো। আমার কোনও স্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। আমি সুতা ব্যবসায়ী হাজী আব্দুল সাত্তারকে সহযোগিতা করি। তিনি সিরাজগঞ্জের ব্যবসায়ী কিন্ত নারায়ণগঞ্জে ব্যবসা করেন। এখানকার তাঁত পল্লী ও জামদানি ভিলেজ-এ তিনি সুতা সরবরাহ করেন।

বস্ত্রসচিব ও ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ব্যাপারে ফজলুল হক বলেন, সবই সাত্তার সাহেব করে। আমি ছাড়াও দুই-একজন সঙ্গে থাকি।

জানা যায়, হাজী আব্দুল সাত্তার বিভিন্ন এলাকায় তাঁতীর কোটায় সুতা, রং ও কেমিক্যাল আমদানি করতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তার লোকজনও এজেন্ট হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় নিয়োজিত রয়েছে। নিজের ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ নানাজনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করেন ও নিয়মিত অর্থ ব্যয় করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাজী আব্দুল সাত্তার বলেন, আমি সুতার ব্যবসা করি, কিন্তু আমি তাঁতী সমিতির কেউ না। আমি তাঁতী কোটায় কোনো সুতা, রং ও কেমিক্যাল আমদানি করি না।

ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক তাঁতী ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) আবু আহমদ ছিদ্দিকী বলেন, ‘এটা অনেক পুরানো অভিযোগ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল আছে। এইসব সিন্ডিকেট মুক্ত করতে তাঁতবোর্ড কাজ করে চলেছে। ’

Comments (0)
Add Comment