কিছুদিন আগেও গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানে ক্যারিয়ার গড়া ছিল আমাদের তরুণদের কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো। কিন্তু নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করছেন দেশের মেধাবী তরুণরা। এখন অনেকটা নিয়মিতই বাংলাদেশি তরুণরা যোগ দিচ্ছেন এসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে। শুধু যোগই দিচ্ছেন না, বলা যায় এসব প্রতিষ্ঠান শাসন করছেন আমাদের তরুণরা। সেই দলের যাত্রী হয়ে এবার বিশ্ববিখ্যাত ইভি ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান টেসলার গিগাফ্যাক্টরি-১-এ সিনিয়র ফ্যাসিলিটিজ ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিয়েছেন হাসান এম রিফাত।
মননশীল ব্যক্তি সংকট
হাসান এম রিফাতের মতো তরুণদের এমন অর্জন যেমন সাফল্যের, তেমনি আমাদের জন্য শঙ্কারও। কারণ কোনো একটি দেশ থেকে উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তিদের অন্য দেশে গমন এবং তা পুরোদমে চলতে থাকাকে বলে মেধা পাচার বা ব্রেইন ড্রেন। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা দলে দলে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ও মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য বিদেশে যাচ্ছেন এবং সেখানেই থেকে যাচ্ছেন। মেধা পাচারের কারণে আমরা আমাদের দক্ষ শ্রমশক্তি ও মননশীল ব্যক্তিদের হারাচ্ছি। বাংলাদেশে যখন দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে, তখন বিষয়টি অবশ্যই দেশের জন্য উদ্বেগের। কারণ, এ সময় দেশের জন্য অনেক বেশি দক্ষ ও মেধাবী শ্রমশক্তি দরকার।
রিফাতের টেসলাযাত্রা
অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো টেসলায় চাকরিপ্রার্থীদের টেকনিক্যাল সক্ষমতাও খুব ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়; সঙ্গে টিমওয়ার্ক এবং কমিউনিকেশন স্কিলও। টেসলায় আবেদনের কিছুদিন পর নিয়োগকারীর সঙ্গে ফোনে ইন্টারভিউর জন্য ই-মেইল আসে। দুই ধাপে ইন্টারভিউর পর প্রতিষ্ঠান জানায়, রিফাতকে প্যানেল ইন্টারভিউর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। রিফাতের প্যানেল ইন্টারভিউয়ে ছয়-সাতজন ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার ও সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। শুরু হয় একটি টেকনিক্যাল সমস্যার ওপর প্রেজেন্টেশন দিয়ে। এরপর সব প্যানেল ইন্টারভিউয়ারের সঙ্গে ওয়ান অন ওয়ান ইন্টারভিউ হয়। সেখানে মূলত টেকনিক্যাল প্রশ্ন করা হয়। এতে তাঁর অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যা; যেমন– সমস্যা সমাধানের মূল কারণ, বিশ্লেষণসহ টেকনিক্যাল সমস্যা দেখিয়ে প্রশ্ন করা হয়। এরপর টেসলার পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়, আপনি পরবর্তী পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিন। এরপর রিফাতকে টেসলা গিগাফ্যাক্টরি-১-এর ইনফ্রাস্ট্রাকচার টিমের ডিরেক্টরের সঙ্গে ৩০ মিনিটের একটি ব্রিফ ফোনকলে অ্যাটেন্ড করতে হয়। এর সপ্তাহখানেক পর প্রতিষ্ঠান থেকে ফোনে জানানো হয়– অভিনন্দন। এরপর ইলন মাস্ক স্বাক্ষরিত অফার লেটার আসে রিফাতের হাতে।
যত ব্যস্ততা
টেসলায় রিফাত ফ্যাসিলিটিজ সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের হয়ে কাজ করছেন। দলটি মূলত ইভি ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের জন্য যাবতীয় সরবরাহ; যেমন– পিওর ওয়াটার, ওয়েস্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট, কেমিক্যাল, গ্যাস, কুলিং ওয়াটার, ড্রাইভ ইউনিট ফ্লুইড, কম্প্রেসড এয়ার ইত্যাদি সরবরাহ করে। এখানে রিফাতের কাজ মাল্টিপল ফ্যাসিলিটিজ সিস্টেমস নিয়ে। টেসলায় তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ওয়েস্ট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট ও রিসাইক্লিং। টেসলার অন্যান্য সাইটের মধ্যে প্রথম গিগাফ্যাক্টরি-১-এ কাজ শুরু করেন রিফাত। প্রজেক্টের নাম অ্যাডভান্সড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট। ২০ মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট এটি। টেসলায় নতুনদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও দেন রিফাত। এ ছাড়া তাঁর কাজের অন্যতম বিষয় সমস্যা সমাধান করা; ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট দেওয়াসহ নানা ব্যস্ততায় টেসলায় দিন পার করছেন রিফাত।
বেড়ে ওঠা এবং পড়াশোনা
সেই এইটুকুন বয়স থেকেই রিফাত বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। সরকারি চাকুরে বাবা ব্যস্ত থাকায় গৃহিণী মায়ের কাছেই তাঁর পড়াশোনার হাতেখড়ি। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত মা গণিত ও ইংরেজি ভালোভাবে পড়িয়েছেন। ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ২০০৮ সালে বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন রিফাত। বুয়েট থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন চাকরি করেন। এরপর পিডিবির অধীন খুলনার খালিশপুর পাওয়ার প্লান্টে যোগ দেন। এখানে চাকরিরত অবস্থায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং মাস্টার্স প্রোগ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেয়ে যান।
ওহাইও ইউনিভার্সিটিতে গ্র্যাজুয়েশনের পর যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কাজ শুরু করেন। অফিস শেষে বাসায় না গিয়ে কফিশপ বা পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে দৈনিক দু-তিন ঘণ্টা পড়তেন রিফাত। চেষ্টা করতে থাকেন প্রকৌশলের সমস্যা বিশ্লেষণ ও ইন্টারভিউর প্রশ্নের ধরন বুঝতে। একসময় সফলতার পথও খুঁজে নেন।
চাকরির বাজার ও উদ্বেগ
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস ও বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে-২০২৩’-এ ফেসবুকের মাধ্যমে ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৫ হাজার ৬০৯ জন অংশগ্রহণকারীর ওপর একটি জরিপ করা হয়। এতে দেখা যায়, বিভিন্ন সমস্যার কারণে যুবসমাজের ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ বিদেশে চলে যেতে চান। গবেষণাটিতে কারণ হিসেবে দুর্নীতি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে সমস্যা সমাধান করার শর্তে ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দেশে ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। সেই দলেরই একজন মনে করি রিফাতকে।
আগামীর স্বপ্ন
রিফাত শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, স্বপ্ন দেখেন দেশের তরুণদের নিয়েও। যেসব তরুণ পড়াশোনা শেষে দেশের বাইরে চাকরি নিয়ে যেতে চান, তাদের সঙ্গে কাজ করতে চান রিফাত। সব ধরনের গাইডলাইনের পাশাপাশি ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়ও তাদের সামনে তুলে ধরতে চান একজন অভিভাবকের মতো করে। শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক নয়, দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়েও কাজ করতে চান তিনি। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপরও গড়ে তুলতে চান বিশেষ প্রতিষ্ঠান। রিফাতদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে আগামীর বাংলাদেশ– এমন প্রত্যাশা তো করতেই পারি আমরা।