পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর প্রতি আল্লাহ তাআলার গভীর ভালোবাসা ও বিশেষ মর্যাদার অসংখ্য নিদর্শন বিধৃত রয়েছে। এই ভালোবাসা কেবল মৌখিক ঘোষণায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাঁর সমগ্র জীবন ও মিশনের প্রতিটি পর্যায়ে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নিচে এরকম ১৫টি উল্লেখযোগ্য দিক বিশদভাবে তুলে ধরা হলো।
১. ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ হিসেবে প্রেরণ
সুরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তো আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ এ আয়াত দ্বারা প্রতিভাত হয় যে, তাঁর আগমন শুধু মানুষের জন্যই নয়, বরং সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য রহমতস্বরূপ।
২. নবীর জীবনের শপথ
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনার জীবনের শপথ, তারা তো তাদের নেশায় মত্ত ছিল।’ (সুরা হিজর: ৭২) এখানে আল্লাহ নিজে নবীজির জীবনের কসম খেয়েছেন, যা তাঁর প্রতি বিশেষ স্নেহ ও মর্যাদারই ইঙ্গিতবাহী।
৩. সুখ্যাতি উচ্চকরণ
সুরা ইনশিরাহর ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি আপনার সুখ্যাতিকে উচ্চ করে দিয়েছি।’ এর বাস্তব রূপ দেখা যায় আজান, নামাজ ও বিভিন্ন ইবাদতে আল্লাহর নামের সঙ্গে নবীজির নাম সংযুক্ত করা হয়েছে।
৪. শত্রুর কবল থেকে সুরক্ষা
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে মানুষের থেকে রক্ষা করবেন।’ (সুরা মায়েদা: ৬৭) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আমিই যথেষ্ট আপনার বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে।’ (সুরা হিজর: ৯৫) কাফিরদের ষড়যন্ত্রের মুখে এ প্রতিশ্রুতি নবীজির প্রতি আল্লাহর বিশেষ রক্ষার প্রমাণ তুলে ধরে।
৫. নবীর প্রতি দরুদ প্রেরণের নির্দেশ
সূরা আহজাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ প্রেরণ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ করো।’ এ নির্দেশনা আল্লাহর প্রিয় বান্দার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসারই ফসল।
৬. আয়াত নাজিল করে বিদ্রুপকারীকে অভিশাপ
আবু লাহাব যখন আমাদের প্রিয়নবী (স.)-কে নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেছে, তাঁর ধ্বংস কামনা করেছে। তার প্রতিবাদে স্বয়ং আল্লাহ পবিত্র কোরআনে আয়াত নাজিল করে দিলেন, ‘ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। (সুরা লাহাব: ১)
৭. আল্লাহর প্রিয়তম
হাদিসে এসেছে আল্লাহ তাআলা হজরত মুহাম্মদ (স.)-কে প্রিয়তম বলে উল্লেখ করেছেন (মুসলিম; ইবনে মাজাহ), যেমনটি ইব্রাহিম (আ.)-কে করেছেন। এটি তাঁর অনন্য মর্যাদার দ্যোতক।
৮. কিবলা পরিবর্তন
সুরা বাকারার ১৪৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ নবীজির আকাঙ্ক্ষা পূরণে কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে কাবার দিকে পরিবর্তন করেন। এটি নবীজির প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের জীবন্ত দৃষ্টান্ত।
৯. নবীর আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য
সুরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।’ এটি নবীজির মর্যাদাকে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ।
১০. বিশেষ গুণে ভূষিত
সুরা আহজাবের ৪৫-৪৬ নম্বর আয়াতে তাঁকে ‘শাহিদ’, ‘মুবাশশির’, ‘নাজির’, ‘দাঈ’ এবং ‘সিরাজাম মুনিরা’ (উজ্জ্বল প্রদীপ) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
১১. হাওজে কাউসার উপহার
সুরা কাউসারে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাউসার দান করেছি।’ এটি কেয়ামতের দিন নবীজির উম্মতের জন্য বিশেষ পানীয়ের ব্যবস্থা, যা তাঁর প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন।
১২. মেরাজ ও আল্লাহর নৈকট্য
মেরাজের রজনীতে নবীজি আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে পৌঁছান, যা অন্যকোনো নবীর ভাগ্যে ঘটেনি। সুরা নাজমের ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারপর তিনি নিকটে আসলেন, এবং আরো নিকটে।’
১৩. উম্মতকে শ্রেষ্ঠ জাতি ঘোষণা
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই হলে শ্রেষ্ঠ জাতি, যাদেরকে মানবজাতির জন্য বের করা হয়েছে।’ নবীজির উম্মতের এ মর্যাদা পরোক্ষভাবে তাঁর প্রতি আল্লাহর অগাধ ভালোবাসারই প্রতিফলন। (সুরা আলে ইমরান: ১১০)
আরও পড়ুন: হাদিসের আলোকে শ্রেষ্ঠ মানুষের ৭ গুণ
১৪. বিশেষ নাম ও গুণবাচক উপাধি
কোরআনে নবীজিকে ‘রাসুলুল্লাহ’, ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে, যা তাঁর সর্বোচ্চ মর্যাদাকেই নির্দেশ করে।
১৫. সর্বোচ্চ চরিত্রবান হিসেবে সার্টিফিকেট
প্রিয়নবী (স.) এতই মর্যাদাবান ছিলেন যে তাঁকে মহান আল্লাহ নিজে সর্বোচ্চ চারিত্রিক সার্টিফিকেট দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলম: ৪)
গবেষণা বিশ্লেষণ
ইসলামিক স্কলার্স ও গবেষকদের বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ (স.)-কে এমন সব মর্যাদা ও ভালোবাসায় ভূষিত করেছেন, যা বিশ্বসৃষ্টির ইতিহাসে অন্যকোনো সৃষ্টির ভাগ্যে ঘটেনি। এই মর্যাদাগুলো প্রতিটি মুসলমানের জন্য এই শিক্ষা বহন করে যে, আল্লাহর প্রেম ও নৈকট্য লাভের জন্য নবীজি (স.)-এর সুন্নতের অনুসরণই হলো একমাত্র পথ। তাঁর প্রতি এই অগাধ স্নেহ ও মহব্বত মুসলিম উম্মাহর ঈমান ও প্রেরণার অফুরান উৎস হিসেবে কাজ করে। এই নিদর্শনগুলো প্রতিটি মুমিনের জীবনে নবীপ্রেম ও আল্লাহপ্রেমের চিরন্তন প্রেরণাদায়ী উৎস।