জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশজুড়ে চলমান ‘মুজিববর্ষের’ মধ্যেই ০১ ডিসেম্বর শুরু হলো বাঙালির কাঙ্ক্ষিত মুক্তিসংগ্রামে বিজয় অর্জনের মাস ডিসেম্বর। আগামী বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনটিকে সামনে রেখে এবারের বিজয়ের মাস বিশেষ তাৎপর্য বয়ে এনেছে বাঙালির জীবনে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্বের মতো এ দেশের মানুষের জীবনেও উৎসবমুখরতা ও প্রাণচাঞ্চল্য অনেকটাই ম্লান, স্থবির। এরপরও এ দেশের দুটি সুমহান অর্জন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব জন্মশতবর্ষকে ঘিরে বিজয়ের মাস এই ডিসেম্বরে জনগণ নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে নতুন করে শপথ নেবে।
৪৯ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই ডিসেম্বরেই বাঙালির নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরের ১৬ তারিখেই আমরা পেয়েছিলাম দেশের স্বাধীনতা। পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, লাল-সবুজের পতাকা। তাই ডিসেম্বর বাঙালি জাতিসত্তা আর নিজস্ব ভূমির গৌরবদীপ্ত বিজয় ও অহংকারের মাস।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই জনগণ বুঝতে পারে, তাদের জয় সুনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। কেননা ডিসেম্বরের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধ সর্বাত্মক রূপ পায়, চলতে থাকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিছু হটতে থাকে। একের পর এক মুক্ত হতে থাকে দেশের বিভিন্ন জায়গা। ১ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী সিলেটের শমশেরনগরে আক্রমণ চালিয়ে টেংরাটিলা ও দুয়ারাবাজার শত্রুমুক্ত করে। মুক্তিবাহিনীর অপারেশনের মুখে পাকিস্তানিরা সিলেটের গ্যরা, আলীরগাঁও ও পিরিজপুর থেকেও ব্যারাক গুটিয়ে নেয়। তবে রাওয়ালপিন্ডিতে এক মুখপাত্র ‘শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শেষ হয়নি’ বলে বিবৃতি দেন।
এ দিনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্ট বক্তৃতায় উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য সরানোর জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। তবে এ সময়ও তৎপর ছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা গোলাম আযম বৈঠক করেছিলেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগের দাবিও তুলেছিলেন। গোলাম আযম কমিউনিস্টদের ‘অপতৎপরতা’ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন। খুলনায় শান্তি কমিটির সদস্যরা হরতাল পালন করে।
গত কয়েক বছরের মতো এবারের বিজয়ের মাসও শুরু হয়েছে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর করার সুদৃঢ় দাবির মধ্য দিয়ে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন হয়ে সরকার সেই বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪২টি মামলায় ৯৯ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় হয়েছে, যাদের অধিকাংশের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির রায় হয়েছে। আপিল বিভাগে ১০ জনের সাজা নিষ্পত্তি হয়েছে। আটজনের ফাঁসির রায় কার্যকরও হয়েছে।
এদিকে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অশুভ গোষ্ঠী নতুন করে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতার নামে এই অপশক্তি ধর্মের অপব্যাখ্যা ও উস্কানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে সংঘাত সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে মেতেছে। এর আগে কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যদিও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর জঙ্গিবিরোধী অবস্থান ও সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে এই অপতৎপরতা অনেকটাই স্তিমিত। তারপরও ভাস্কর্যকে ইস্যু করে মৌলবাদী অপশক্তির নতুন ষড়যন্ত্র নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা রয়েছে জনমনে।
তবে ঐক্যবদ্ধ জনগণ প্রতি বছরের মতো এবারও বিজয়ের মাসে বিজয়ের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হবে। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শোকে মুহ্যমান হয়ে মাথা নোয়াবে অগণিত মুক্তিযোদ্ধার প্রতি। যদিও করোনার কারণে এবার মহান বিজয়ের মাসের কর্মসূচি অনেকটাই সীমিত থাকবে। তারপরও নানা আয়োজনে সবার চেতনায় ধ্বনিত হবে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথার স্মৃতিচারণ আর বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত ভালোবাসা।
বিজয়ের স্মারক ডিসেম্বরের প্রথম দিনটিতে বিভিন্ন দল ও সংগঠন আজ দেশজুড়ে পালন করবে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক-আর্থিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মানবোধ জাগানোর লক্ষ্যে প্রতি বছরের মতো এবারও দিবসটি পালিত হবে।
এ উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে। সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্য পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্যজোট, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদসহ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন চত্বরে সমাবেশ, শ্রদ্ধা নিবেদন ও শপথ গ্রহণের কর্মসূচি নিয়েছে। সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এদিন সকাল ১০টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচার স্বাধীনতা ভবনে সংগঠন কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিনিধিদের নিয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়ও মুক্তিযোদ্ধা দিবস উদযাপন কমিটি আলোচনা অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করবে। এ উপলক্ষে আজ সকাল সাড়ে ৯টায় দলটি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তনে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। এছাড়া জাসদ ঢাকা মহানগর পশ্চিম কমিটি সকাল ৮টায় মিরপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন ও কবরস্থানের বাইরের চত্বরে আলোচনা সভার কর্মসূচি নিয়েছে।