বর্এমান এমপিরা আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না-ও পেতে পারেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে জরিপ করছেন তিনি। এই জরিপ চলছে, চলবে। গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরাই দলের মনোনয়ন পাবেন।
তিনি বলেছেন, টাকা দিয়ে দলের বিভিন্ন কমিটিতে আসার অভিযোগও রয়েছে। এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে। টাকা নেই বলে ত্যাগী ও স্বচ্ছ ইমেজের নেতাদের কমিটিতে রাখা হবে না- এটা ঠিক নয়।
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন খুবই টাফ হবে; প্রতিযোগিতামূলক হবে। এখন মুখে ‘না’ বললেও বিএনপি নির্বাচনে আসবে। কারণ বিএনপি ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই নির্বাচনকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
এই বৈঠকে আগামী ২৪ ডিসেম্বর শনিবার আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওইদিন সকাল ১০টায় রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিসহ ১১টি উপকমিটি গঠনের নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আগে যাঁরা কমিটিতে ছিলেন, তাঁরাসহ দক্ষ ও অভিজ্ঞদের নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে উপকমিটিগুলো করে ফেলার জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দেন তিনি। তবে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর কারণে অভ্যর্থনা উপকমিটিতে পরিবর্তন আসবে। সম্মেলন সামনে রেখে দলীয় গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র যুগোপযোগী করতে সংশোধনের ওপরে জোর দেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠকে আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর দলের জাতীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বৈঠকে দলের বাজেট অনুমোদন করা হবে। ২১ ও ২২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে বলেই বিএনপি আজ আন্দোলন করতে পারছে। কিন্তু বিএনপির যারা খুনের সঙ্গে জড়িত; অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত; জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত; তাদের ধরতে হবে। তাদের কোনো ছাড় নেই।
জাতীয় কাউন্সিলের জন্য সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করতে হবে। কতগুলো উপকমিটি করতে হবে। তবে যেহেতু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা যাচ্ছে; ফলে এবারের সম্মেলন আমরা কোনো শান-শওকত করে করব না। খুব সীমিত আকারে, অল্প খরচে এবং সাদাসিধাভাবে আমাদের সম্মেলন করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এটা আমরা করে যাব। আমার কথা হচ্ছে- আমাদের উন্নয়নের কথাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য আমরা যে পরিকল্পনাগুলো নিয়েছি, সেটাও মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপির আমলে তারা লুটপাট, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি, গ্রেনেড হামলা, অত্যাচার, নির্যাতন, খুন, রাহাজানিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তারা না করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জনকারী বাংলাদেশকে তারা বিশ্বের কাছে ভিখারির দেশে পরিণত করেছিল। হাত পেতে চলার দেশে পরিণত করেছিল। সেখান থেকে বাংলাদেশকে আমরা তুলে এনে আজ আত্মমর্যাদাশীল একটা রাষ্ট্র করেছি। যে বাংলাদেশকে সারাবিশ্বের মানুষ একটা সম্মানের চোখে দেখে।
প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বৈঠকের পর তাঁর সভাপতিত্বে বিকেল সাড়ে ৪টায় কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক শুরু হয়। প্রায় ছয় ঘণ্টার বৈঠকে দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাড়াও কেন্দ্রীয় নেতা বেশ কয়েকজন বক্তব্য দেন। শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন দলের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ূয়া। দায়িত্বপ্রাপ্ত আট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, এসএম কামাল হোসেন, মির্জা আজম, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, সফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও সাখাওয়াত হোসেন শফিক স্ব স্ব বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট তুলে ধরেন।
এ ছাড়া বৈঠকে সারাদেশে দলের সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা, মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, কৌশল নির্ধারণসহ এক গুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়। এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জেলায় জেলায় সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী: বৈঠকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জেলায় জেলায় সফরে বের হওয়ার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এখন থেকে দলকে আরও সময় দেবেন তিনি। সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় রেখে জেলায় জেলায় জনসভা ও জনসমাবেশ করবেন তিনি। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সিলেট থেকে এই জেলা সফর শুরু করবেন। এর পর তিনি ঝালকাঠি, রাজশাহী, যশোরসহ বিভিন্ন জেলা সফর করবেন। চট্টগ্রামে ৪ ডিসেম্বর দলীয় জনসভায় সভাপতিত্ব করবেন। ওই দিন সকালে সেখানে সেনাবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে বিকেলে জনসভা করবেন। এ ছাড়া জেলা নেতাদের পর্যায়ক্রমে ঢাকায় ডেকে মতবিনিময়ও করবেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সব জেলা সম্মেলন দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যেসব জেলায় সম্মেলন হয়েছে অথচ পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি; জেলা নেতাদের মাধ্যমে সেগুলো দ্রুত জমা নিয়ে অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। যেসব জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকবে, সেসব জেলায় আগে সফর ও জনসভা করবেন তিনি। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ও নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে নিয়ে সমাবেশ করা হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
বিদ্রোহী প্রার্থীরা ক্ষমা চাইলে পর্যালোচনা করা হবে: জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে দলীয় সর্বশেষ অবস্থান জানতে চেয়েছিলেন একজন কেন্দ্রীয় নেতা। জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি জানান, বিদ্রোহী প্রার্থীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইলে পর্যালোচনা করা হবে। তবে যেসব মন্ত্রী-এমপি বা কেন্দ্রীয় নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হতে উৎসাহিত করেন, তাঁদেরও এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
আপাতত নতুন উন্নয়ন প্রকল্প নয়: প্রধানমন্ত্রী জানান, আপাতত সরকার নতুন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেবে না। পুরোনো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোই শেষ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে দলের এমপি ও জনপ্রতিনিধিসহ নেতাদের সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনগণের কাছে তুলে ধরার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, এলাকাভিত্তিক উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে লিফলেট ও পুস্তিকা তৈরি করে জনগণের মধ্যে প্রচার করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে দলের পক্ষে ভোট চাইতে হবে। উঠান বৈঠক ও গণসংযোগসহ জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে।
অন্যান্য প্রসঙ্গ: সাম্প্রতিক জেলা পরিষদ নির্বাচনে নরসিংদী, ফরিদপুর ও সুনামগঞ্জ কয়েকটি জেলায় দল সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয়ের বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এই পরাজয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়ের পেছনে দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার হাত ছিল বলেও অভিযোগ ওঠে।
সাদামাটাভাবে জাতীয় কাউন্সিল: ওবায়দুল কাদের
বৈঠকের মাঝে মাগরিবের নামাজের বিরতিতে বাইরে এসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, আগামী ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। এবারের সম্মেলন একদিনেই হবে। সম্মেলন হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আনুষ্ঠানিকতার পেছনে ব্যয় কমানো হবে। সাদামাটাভাবে আয়োজন করা হবে সম্মেলন।
সম্মেলনে বিদেশি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আগামী ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি যোগ দেবেন বলে জানান ওবায়দুল কাদের।