ফ্যামিলি মেডিসিন, জেনারেল প্র‍্যাকটিসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না দিলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন অসম্ভব

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের ওয়েবিনারে বক্তারা

বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রেই ফ্যামিলি মেডিসিনের প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করেন। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তার জন্য প্রয়োজনীয় কোন ফ্রেমওয়ার্ক, পলিসি, কাঠামো বা রোডম্যাপ নেই। ফ্যামিলি মেডিসিনকে মেডিকেল এডুকেশনের সাথে সমন্বয় করতে হবে। ফ্যামিলি মেডিসিনের কোর্সকে সরকারি পর্যায় থেকে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।

(২৪ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘কার্যকর জেনারেল প্র‍্যাকটিস (জিপি) সিস্টেম ছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কি সম্ভব?’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বাংলাদেশে জেনারেল প্র‍্যাকটিস এবং ফ্যামিলি মেডিসিন বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা বিশিষ্ট চিকিৎসকরা এসব মতামত ব্যক্ত করেন।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের সদস্য ডা. মোহিব নীরবের সঞ্চালনায় এতে আলোচনায় অংশ নেন
বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস এন্ড সার্জনস এর ফ্যাকাল্টি অফ ফ্যামিলি মেডিসিনের সদস্য সচিব, প্রাভা হেলথ এর কনসালট্যান্ট (ফ্যামিলি মেডিসিন) ডা. লে. কর্নেল (অবঃ) মো. কবির আহমেদ খান; মেম্বার অফ রয়াল কলেজ অফ জেনারেল প্র‍্যাকটিসনারস (ইউ,কে), রয়াল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস (ইউ,কে) এর মেম্বার, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল এর সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম ওসমান গণি; বাংলাদেশ কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর) এর মেডিসিন কনসালট্যান্ট, বাংলাদেশ কলেজ অফ জেনারেল প্র‍্যাকটিসশনারস এর ফ্যাকাল্টি ও এক্সামিনার ডা. শারমিন আহমেদ।

বক্তব্যের শুরুতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য এমন একটি প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত বিষয় নির্ধারণের জন্য ধন্যবাদ জানান ডা. কবির। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রেই ফ্যামিলি মেডিসিনের প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করেন। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তার জন্য প্রয়োজনীয় কোন ফ্রেমওয়ার্ক, পলিসি, কাঠামো বা রোডম্যাপ নেই। তাই তরুণ চিকিৎসকদের অনেকেই ফ্যামিলি মেডিসিন সম্পর্কে জানেন না। অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও একে অবহেলার চোখে দেখেন। সাধারণ মানুষেরা এ থেকে কি সুবিধা পাওয়া যাবে তা জানেন না। দেশে এ বিষয়ে প্রচুর কোর্স চালু হলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই একে সাধারণ মানুষের কাছে নেয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে সাধারণ মানুষ ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত। অথচ বিত্তশালীরা বড় বড় হাসপাতালে বা বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এসব বৈষম্য কমাতে হলে একটি কার্যকরী জেনারেল প্র‍্যাকটিস সিস্টেম চালু করতে হবে। সেজন্য দক্ষ এবং বিদ্বান জেনারেল প্র‍্যাকটিসনার প্রয়োজন যাদের ফ্যামিলি মেডিসিনে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। ফ্যামিলি মেডিসিনকে মেডিকেল এডুকেশনের সাথে সমন্বয় করতে হবে। ফ্যামিলি মেডিসিনের মাধ্যমে জেনারেল প্র‍্যাকটিসনার তৈরি করতে হবে। তাকে জেনারেল প্র‍্যাকটিসনার, ফ্যামিলি ডক্টর বা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান যেকোন নামে ডাকা যেতে পারে। তাদেরকে ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হতে হবে যাতে আত্মবিশ্বাসের সাথে তারা রোগী দেখতে পারেন এবং রোগীরাও তাদের কাছে আস্থা পান। তাদের উপর রোগীরা আস্থা রাখতে না পারলে কাংখিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দাঁড় করানো যাবে না।

ডা. গণি বলেন, আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় সাধারণ মানুষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানোর মতো অবস্থায় থাকেন না। খুব বেশি মানুষ চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন, তাও বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকদের বাইরে বিশাল একটা গোষ্ঠী রয়েছে যাদেরকে মানুষ দিনরাত যেকোন সময় কাছে পান। সুতরাং তারা সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি অবস্থান করেন।

তিনি বলেন, করোনাকালে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার জায়গাগুলো স্পষ্ট হয়ে গেছে। সরকারি চিকিৎসকের তুলনায় বেসরকারি চিকিৎসক কয়েকগুণ বেশি হলেও তারা কে কোথায় আছেন তা নিয়ে কোন ভালো ডাটাবেইজ নেই। লাখ খানেক চিকিৎসকের বিপরীতে প্রতি ঘরেই যদি রোগী থাকে তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা যা-ই থাকুক তা দিয়ে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। জেনারেল প্র‍্যাকটিসনার হিসেবে অনেকে ঔষধের দোকান সহ নানা স্থানে বসলেও তাদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। অথচ করোনা কিন্তু জেনারেল প্র‍্যাকটিসনারদেরই মোকাবিলা করার কথা ছিল। যেকোন কিছুতেই মানুষ ছুটে হাসপাতালে যাচ্ছে। করোনায় আক্রান্তের চেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম হলেও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় প্রস্তুতির অভাব থাকায় মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মানুষ যদি হাতের কাছেই জেনারেল প্র‍্যাকটিসনার মা ফ্যামিলি ডক্টর পেতেন তাহলে আর এদিক-সেদিক যেতেন না।

তিনি বলেন, রোগী যখন বিশেষজ্ঞের কাছে যাচ্ছেন তিনি তখন রোগী নন, ব্যক্তি হয়ে যাচ্ছেন। কারণ তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোন নথি সেখানে যাচ্ছে না যেটা তার প্রাথমিক চিকিৎসকের সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু দেশে এমন ব্যবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। অথচ সে ব্যবস্থা থাকলে হয়তো বিশেষজ্ঞের কাছে যেতেই হতো না, কেননা হাতের কাছের পরিচিত চিকিৎসক যিনি রোগীকে দীর্ঘদিন চেনেন তিনি খুব সহজেই তার রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে পারতেন।

ডা. কবির বলেন, দেশে রেফারেল সিস্টেমের জন্য সরকারিভাবে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যেকোন রোগী চাইলে যেকোন সময় যেকোন চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন। আর সেজন্যই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোন স্তর- প্রাইমারি-সেকেন্ডারি-টারশিয়ারি, কাজ করে না।

মানুষ শুরুতেই কেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাবেন প্রশ্ন রেখে ডা. শারমিন বলেন, ফ্যামিলি ডক্টর যখন দেখবেন রোগীর চিকিৎসা আর তার আওতার মধ্যে নেই তখন তিনি তাকে বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাবেন। বিশেষজ্ঞ যদি দেখেন রোগীর আর দ্বিতীয়বার আসার প্রয়োজন নেই তখন তিনি ফ্যামিলি ডক্টরকে তা জানিয়ে একটি গাইডলাইন দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের উপর থেকে রোগীর চাপও কমে যাবে। অথচ বর্তমানে এ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞও রোগীর চাপে অনেক সময় ঠিকঠাক চিকিৎসা দিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে বিত্তবান অনেকে আস্থা হারিয়ে বিদেশে চলে যান। ফলে জগাখিচুরি অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই জরুরিভিত্তিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ফ্যামিলি মেডিসিনের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে তাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় সংযুক্ত করতে হবে।

ডা. গণি মনে করেন, দেশে ফ্যামিলি মেডিসিনের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে যেমন জনমত তৈরি করতে হবে, তেমনি চিকিৎসকদের নিজেদেরও ব্যক্তিস্বার্থের কথা না ভেবে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। তবে তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।

ডা. কবির বলেন, নবীন চিকিৎসকদের ফ্যামিলি মেডিসিনে আসতে আগ্রহী করতে হলে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পিপলস পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) এর মাধ্যমে পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। নবীনদের এক্ষেত্রে সম্ভাবনা দেখাতে পারলে নিশ্চয়ই তারা আগ্রহী হবেন৷ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অনেক ভালো নীতি থাকলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন নেই বা করা যাচ্ছে না।

ডা. শারমিন বলেন, ফ্যামিলি মেডিসিনের কোর্সকে সরকারি পর্যায় থেকে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। জেনারেল প্র‍্যাকটিসনারদেরও নিজেদের জ্ঞানকে ‘আপডেট’ রাখতে হবে।

Comments (0)
Add Comment