ফুটবল দুনিয়ায় সবার পরিচিত নাম লিওনেল মেসি। বল আর বাম পায়ের জাদুতে নান্দনিক খেলায় তিনি মুগ্ধ করেছেন পৃথিবীর কোটি কোটি ফুটবল ভক্তকে। সর্বকালের সেরাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই তারকা ফুটবলার। বিশ্ব ফুটবলের সব ক্ষেত্রেই অর্জন করেছেন সাফল্য। এতে নিজ দেশ আর্জেন্টিনা থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত প্রায় সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যেও রয়েছে মেসি ভক্ত। ফুটবলের সেই রাজপুত্র লিওনেল মেসির আজ ৩৮তম জন্মদিন।
২০২৩ সালে মেসির জন্মদিন উদযাপন: ছবি- সংগৃহীত
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
‘মেসি’ নামের এই তারকার গল্পটা শুরু হয়েছিল ৩৮ বছর আগে আজকের দিনে। ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন আর্জেন্টিনার রোজারিওর এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। বাবা হোর্হে হোরাসিও মেসি কাজ করতেন রোজারিওর একটি স্টিল কারখানায়। আর মা সেলিনা মারিয়া কুচ্চিত্তিনি ছিলেন পার্ট-টাইম ক্লিনার। চার ভাইবোনের মধ্যে মেসি তৃতীয়। তার বড় দুই ভাই রদ্রিগো ও মাতিয়াস। ছোট বোন মারিয়া সল। ছোটবেলা থেকেই তাদের পরিবার ছিল ফুটবলপ্রেমী। বড় দুই ভাই ও দুই মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে ফুটবল খেলেই বাল্যকাল কেটেছে তার। লিওনেল মেসি মাত্র ১৩ বছর বয়সে আর্জেন্টিনা থেকে স্পেনের বার্সেলোনায় চলে আসেন।
আর্জেন্টাইন মহাতারকা ফুটবলার মেসির আক্রমন রুখে দিতে তৎপর প্রতিপক্ষের খেলোয়ার। ছবি- সংগৃহীত
শিক্ষা জীবন
পড়াশোনায় মেসি একজন মাঝারি ধরনের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১১ বছর পর্যন্ত আর্জেন্টিনার কোলেজিও জেনারেল লাস হেরাস স্কুলে পড়েছেন তিনি। স্কুলে মেসি আর দশজন সাধারণ শিক্ষার্থীর মতোই পড়ালেখা করেছেন। তিনি সবসময় একটি বল নিয়ে স্কুলে যেতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করার পর, তার পরিবার ১৩ বছর বয়সে বার্সেলোনায় স্থানান্তরিত হয়। তিনি বার্সেলোনার বিখ্যাত লা মাসিয়াতে যোগ দেন, ফুটবলের অন্যতম সেরা প্রশিক্ষণ সুবিধা পেতে। তবে কলেজ পর্যন্ত যাওয়ারও সুযোগ হয়নি ফুটবলের এই মহাতারকার। স্পেনে থিতু হওয়ার পর বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের ইয়ুথ একাডেমি লা মাসিয়াতে তার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এই একাডেমির শিক্ষার্থী হিসেবে একটি এলিমেন্টারি স্কুলে মেসি পড়াশোনা করেছেন বলে জানা গেছে। মেসির ভাষা স্পানিশ। তিনি ইংরেজি জানেন না।
পরিবারের সঙ্গে লিওনেল মেসি। ছবি- সংগৃহীত
বার্সেলোনায় মেসি
বার্সেলোনার জার্সিতে লিওনেল মেসির অভিষেক হয় ১৬ অক্টেবর ২০০৪ সালে। মেসির বয়স তখন ১৭ বছর ৩ মাস ২২ দিন। অভিষেকের সাত মাস পর ২০০৫ সালের ১ মে ক্লাবের জার্সিতে প্রথম গোল পান এই ফুটবল জাদুকর। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। লা মাসিয়া থেকে উঠে আসা এই আর্জেন্টাইন ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়ে কাতালুনিয়ার দলটিকে সাফল্য এনে দিয়েছেন মুঠোভরে।
এর আগে, ১১ বছর বয়সে মেসির শরীরে গ্রোথ হরমোন জনিত জটিলতা দেখা দেয়। কিন্তু তার বাবা মায়ের সেটার চিকিৎসা করার মত সামর্থ্য ছিল না। এই চিকিৎসার খরচ ছিল প্রতিমাসে প্রায় ৯০০ ডলার। সেই চিকিৎসার জন্যই বার্সেলোনায় গিয়েছিলেন মেসি ও তার পরিবার। মেসিরা ২০০০ সালে কাতালান শহরটিতে যান। যুব দল পেরিয়ে ২০০৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে নাম লেখান বার্সেলোনার সিনিয়র দলে।
বার্সেলোনায় যোগদানের পর টানা ২ দশক ধরে পুরো ফুটবল বিশ্বকে নিজের জাদুতে মাতিয়ে রাখেন এই আর্জেন্টাইন ফুটবলার। নিজের ক্লাব ফুটবল কেরিয়ারে বার্সেলোনার হয়ে ৭৭৮টি ম্যাচে ৬৭২ গোল আর পিএসজির হয়ে ৭৫ ম্যাচে ৩২ গোল করেছেন মেসি।
মাঠের লড়াইয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে মেসি। ছবি- সংগৃহীত
বিশ্বকাপ ফুটবলে মেসি
২০১৮ বিশ্বকাপে যখন বাছাই পর্বেই বাতিল হবার পথে আর্জেন্টিনা, তখন অবসর ভেঙ্গে ফিরে এসে দেখিয়েছেন বাঁ পায়ের জাদু। বাছাই পর্ব উতরে মূল পর্বের খেললেও ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরের চাপটাই যেনো নিতে পারছিলেন না। পরের বছরের কোপা আমেরিকায় আবারও ব্যর্থ হলে শূন্য হাতে তার বিদায় যেনো নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালে ১৬ বছর পর জাতীয় দলের হয়ে তার শিরোপা জয়ের আক্ষেপ মেটে। কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে শিরোপাটা যেনো তারই প্রাপ্ত ছিল।
২০০৬ থেকে শুরু, ২০১০ হয়ে ২০১৪, পেরিয়েছে ২০১৮ বিশ্বকাপও। চোখের নোনা জল বারবার হতাশার রেশ তুলে গেছে। তার বিরস নয়নে চেয়ে থাকা বলে যায় একের পর এক বিরহের কবিতা। কানে বাজে বাশির করুণ সুর।এরপরই আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ, ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে লিওনেল মেসির জাদুতেই ৩৬ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে আকাশি-নীল শিবিরে। সেই সাথে ‘অমরত্ব’ পেয়ে যান আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর।
২০২২ সালের বিশ্বকাপে এসে ক্যারিয়ারের একমাত্র অপূর্ণতাটা পূর্ণ হয় এই ফুটবল জাদুকরের। লুসাইল স্টেডিয়ামে সেই ফ্রান্সকেই হারিয়ে মেসি স্বাদ নেন বিশ্বকাপের। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ, আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল, ভিন্ন পাঁচ বিশ্বকাপে অ্যাসিস্ট, বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ ম্যাচ, সবচেয়ে বেশি সময় খেলা, সবচেয়ে বেশি গোলে অবদানসহ মেসি একাই যেন নিজের করে নেন কাতার বিশ্বকাপ।
কাতার বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে মেসি। ছবি- সংগৃহীত
ব্যক্তিগত অর্জন
ম্যানচেস্টার সিটির ফরোয়ার্ড আর্লিং হালান্ডকে পেছনে ফেলে ২০২২-২৩ মৌসুমের রেকর্ড অষ্টমবারের মতো ব্যালন ডি’অরের পুরস্কার জিতেছেন লিওনেল মেসি। ফুটবলের অস্কার খ্যাত এই পুরস্কার মেসি সর্বোচ্চ আটবার জিতেছেন। তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ধরাছোয়ার বাইরে। ১৯৫৬ সাল থেকে চলে আসা এ পুরস্কার মেসির হাতে প্রথম ওঠে ২০০৯ সালে। এরপর ২০১১, ২০১২, ২০১৩, ২০১৬, ২০১৯, ২০২১ এবং ২০২৩ সালে ব্যালন ডি’অর জেতেন সাবেক বার্সেলোনা তারকা।
২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মেসি ও রোনালদো ব্যতীত কেবল দুইজন এই পুরস্কার জিতেছেন। ২০১৮ সালে রিয়াল মাদ্রিদের লুকা মদ্রিচ ও ২০২২ সালে রিয়াল মাদ্রিদের ফরাসি তারকা করিম বেনজেমা ব্যালন ডি’অর নিজের করে নেন।
যেমন বিদায় হতে পারে মেসির
মেসি চাইলে ২০২২ সালের ডিসেম্বরেই বিদায় বলে দিতে পারতেন। অমরত্বের মধু গলায় ধারণ করেই চলে যেতে পারতেন ফুটবলের মঞ্চ ছেড়ে। কিন্তু বয়ে যাওয়ার স্বাদটা পেতে চেয়েছিলেন বলেই হয়তো আরও কিছু সময়ের জন্য থেকে গেলেন। আরও কিছু অমর দৃশ্য রচনা করলেন। কিন্তু অতিরিক্ত সময়েরও যে শেষ আছে, মেসির এবারের জন্মদিনটা সে কথাই যেন বারবার মনে করে দিচ্ছে। তবে গল্পের নায়ক গোধূলিবেলায় বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে নিতে বিদায়ের বিউগলটা নিজের হাতেই তুলে নিয়েছেন। ২০২৬ বিশ্বকাপে সেই বিউগল বাজিয়ে ইতি টানবেন সব আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া–পাওয়ার। সেই মঞ্চে মেসি শেষ পর্যন্ত সফল হোন বা ব্যর্থ, মাথা উঁচু করে মহানায়কের বেশে নিজেই নামিয়ে দেবেন নাট্যমঞ্চ থেকে বিদায়ের পর্দা।
ইন্টার মিয়ামির জার্সি গায়ে আক্রমনে মেসি। ছবি- সংগৃহীত
অতিনাটকীয় কিছু না হলে আমরা হয়তো ফুটবলার হিসেবে সক্রিয় মেসির আরেকটি জন্মদিন উদ্যাপন করতে পারব। ২০২৬ বিশ্বকাপের উত্তেজনা যখন চূড়ায় থাকবে, তখনই নিজের ৩৯তম উদ্যাপনটি করবেন মেসি। আরেকটি বিশ্বকাপ জিতেই হয়তো সেই জন্মদিনটা রাঙাতে চাইবেন ফুটবলের রাজপুত্র লিওনেল মেসি।
তবে সেই অর্জন আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দেওয়া মেসির নয়, সেটা হবে তাকে যারা ভালোবেসে নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছেন, তাদের অর্জন। মেসিপ্রেমীদের জন্যও অবশ্য এই অর্জন খুব জরুরি কিছু নয়। তারা তো মাঠে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা মেসিকে দেখেও অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারবে। ভালোবাসা নামের দুর্লভ বস্তুটা যে এমনই!