ফিলিস্তিন ভূমির দখল ও বিজয়ের নিরব সাক্ষী যে মসজিদ

এক সময় ফিলিস্তিনিদের গাজার মানুষের নামাজ, ইবাদত ও আবেগভরা দোয়ার নিরব সাক্ষী ছিল ঐতিহাসিক আল-ওমরি মসজিদ। ঐতিহাসিক স্থাপনাটি মসজিদে রূপান্তর হওয়ার পর একাধিকবার দখল ও ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। তবে প্রতিবারই ফিরে পেয়েছিল আসল রূপ। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর টানা আগ্রাসনে আরবো ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে প্রাচীন এই ধর্মীয় স্থাপন।

মসজিদটি এখন হারিয়ে তার আসল জৌলুস। ইসায়েলের নির্বিচার গণহত্যা, বোমাবর্ষণের পরও এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদের মিনারের একটি অংশ, যেন নীরবে সাক্ষ্য দিচ্ছে ইসরায়েলি বর্বরতার।

আল-জাজিরা মুবাশিরের সাম্প্রতিক প্রকাশিত ড্রোন চিত্রে ওমরি মসজিদ

আল-জাজিরা মুবাশিরের প্রকাশিত বিশেষ ড্রোন চিত্রে ধরা পড়েছে মসজিদটির ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য। দেখে মনে হবে যেন পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক পরিচয় মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

গাজার প্রাচীন নগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ওমরি মসজিদটি এলাকার সবচেয়ে পুরনো ধর্মীয় স্থাপনা। জনপ্রিয় বাজার এলাকার কাছেই এর অবস্থান। প্রায় ১,৬০০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত মসজিদের মধ্যে ৪১০ বর্গমিটার ছিল মূল নামাজঘর, আর বাকি ১,১৯০ বর্গমিটার ছিল খোলা প্রাঙ্গণ, যেখানে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতেন হাজারো মুসল্লি।

মজবুত মার্বেল পাথরের ৩৮টি স্তম্ভে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটি ছিল এক অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন। এই মসজিদই ছিল গাজার সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। পুরো ফিলিস্তিনে আয়তনে তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ হিসেবে এর অবস্থান। আল-আকসা, আক্কার আহমদ পাশা আল-জাজ্জার মসজিদের পরেই এর স্থান।

যুগে যুগে রূপান্তর

মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর নামে। এটি ‘বড় মসজিদ’ বলেও পরিচিত।

মসজিদের ইতিহাস প্রাকখ্রিষ্টীয় যুগ পর্যন্ত প্রসারিত। প্রাচীনকালে এটি একটি উপাসনালয় ছিল। পঞ্চম শতকে বাইজেন্টাইনরা এটিকে চার্চে রূপান্তর করে। সপ্তম শতকে মুসলমানদের বিজয়ের পর আবার এটি মসজিদে পরিণত হয়।

ওমরি মসজিদের বর্তমান চিত্র

 

খ্রিষ্টীয় ১০৩৩ সালে ভূমিকম্পে এর মিনার ধসে পড়ে। পরে ক্রুসেডাররা ১১৪৯ সালে এটি দখল করে ‘জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট’ নামে এক কাথেড্রাল বানায়। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নেতৃত্বে মুসলমানরা ১১৮৭ সালের হিত্তিন যুদ্ধের পর গাজা পুনরুদ্ধার করে মসজিদটি ফের নির্মাণ করেন।

১৩শ শতকে মামলুক শাসকেরা আবার সংস্কার করেন, কিন্তু ১২৬০ সালে মঙ্গোল আক্রমণে এটি ধ্বংস হয়। পরবর্তীতে মুসলমানরা আবারও পুনর্নির্মাণ করেন। একই শতাব্দীর শেষ দিকে আরেক ভূমিকম্পে মসজিদটি পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পুনর্গঠন ও ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি

১৫শ শতকে অটোমানরা মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বোমাবর্ষণে এটি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯২৫ সালে ফিলিস্তিনি ইসলামী উচ্চ পরিষদ এটি পুনরুদ্ধার করে। এরপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত মসজিদটি গাজার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে।

গাজা সরকারের তথ্য অফিস গত মাসে জানিয়েছিল, দখলদার বাহিনীর অব্যাহত বোমাবর্ষণে গোটা অঞ্চল এখন ‘পরিবেশগত ও স্থাপত্যগতভাবে বিপর্যস্ত এলাকা’।

তারা জানায়, গাজায় এ পর্যন্ত প্রায় ৭ কোটি টন ধ্বংসাবশেষ জমেছে এবং প্রায় ২০ হাজার অবিস্ফোরিত বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র এখনো বেসামরিক জনগণের জীবনের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে।

সূত্র :  আল জাজিরা মুবাশির