প্রযুক্তির আসক্তি ও মানব জীবনের প্রভাব

প্রযুক্তির আসক্তি ও মানব জীবনের প্রভাব

প্রযুক্তির আসক্তি ও মানব জীবনের প্রভাব

২০১৩ সালে ক্লেইনার পার্কিন্সের এক জরিপ অনুযায়ী প্রতিদিন একজন মানুষ গড়ে ১০০-১৫০ বার তার মোবাইল ফোন চেক করতো। ৩ বছরের মাথায় ২০১৬ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ২৬১৭ বারে! ২০২৫ এর রিপোর্ট দেখলে দুনিয়া হয়ত নতুন করে ভাবতে শুরু করবে। আমেরিকান শিশু-কিশোরদের ৯২ ভাগই প্রতিদিন অনলাইনে যায়। প্রতি ৫ জনে ১ জন কিশোর গভীর রাতে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে শুধু এটা দেখার জন্যে যে, তার মোবাইলে নতুন কোনো মেসেজ এসেছে কি না। (জার্নাল অব ইয়ুথ স্টাডিজ)

একজন পূর্ণ বয়স্ক কানাডিয়ান গড়ে দিনে দু’ঘণ্টা সোশাল মিডিয়ায় কাটায়। আর শিশুকিশোররা কাটায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। তার মানে, আজ যে শিশুর বয়স ৮, সে তার জীবনের ১৫টি বছরই কাটিয়ে দেবে অন স্ক্রিনে।

পৃথিবীতে ফেসবুক ব্যবহার করছে এখন ২০০ কোটিরও বেশি মানুষ। নিজের স্মার্টফোনে টুইটার, ইনস্টাগ্রাম বা স্ন্যাপচ্যাট নেই এমন তরুণ-তরুণীকে বোধ হয় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফেসবুকে নাকি প্রতিদিন আমরা ১৮০ কোটি ছবি আপলোড করি!

গত দুই দশকে স্মার্টফোন এবং এখানে রাখা যায়, এমন সব যোগাযোগ ও ম্যাসেজিং অ্যাপ আমাদের জীবনকে কতটা প্রভাবিত করেছে, তার কিছু নমুনা পাওয়া যায় এ তথ্যগুলোতে!

কিন্তু পৃথিবীব্যাপী এ তথ্যগুলো কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? মোটেই না। বরং সিলিকন ভ্যালির গুটিকয় চতুর প্রোগ্রামার একসাথে মিলে সব জেনেবুঝেই এই ফোন, অ্যাপ এবং সোশাল মিডিয়ার সাইটগুলোকে এমনভাবে তৈরি করছে, যা সাধারণ মানুষকে এটা ব্যবহারে আসক্ত করে ফেলছে।

আসক্তিকর প্রযুক্তি ডিজাইন ক্লাস!

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বিজে ফগ। প্রযুক্তিকে কীভাবে মানুষের মনোলোভা করে তুলতে হয়, তার কৌশল শেখানোর মাস্তানলোক মনে করা হয় আচরণ মনোবিজ্ঞানের এই অধ্যাপককে। ‘পারসুয়েসিভ টেকনোলজি ডিজাইন ক্লাস’ নামের ঐ ক্লাসে তিনি ছাত্রদের শেখান কীভাবে মানুষের মনোজগতের সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে আকর্ষণীয় প্রযুক্তিপণ্য তৈরি করা যায়!

তার সফল ছাত্রদের একজন নির ইয়াল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা রপ্ত করে সিলিকন ভ্যালিতে যিনি বেশ ভালোভাবেই গুছিয়ে নিয়েছেন নিজের আখের। ‘সানফ্রান্সিককো বে’সহ অপরাপর শহরগুলোতে আয়োজিত তার কনফারেন্সে টিকেটপ্রতি ১৭০০ (!) ডলার কেটে মানুষ আসে বক্তৃতা শুনবার জন্যে। যেসব বক্তৃতায় নির ইয়াল শেখান প্রযুক্তি ব্যবহারে কীভাবে মানুষকে অভ্যস্ত করানো যায়। আর বক্তৃতা শুনতে যারা আসে, তাদের মধ্যে আছে ডিজাইনার, প্রোগ্রামার এবং উদ্যোক্তা। নির ইয়ালের লেখা একটি বই হলো ‘Hooked: How to Build Habit-Forming Products’। নাম থেকেই স্পষ্ট নির ইয়ালের কাজের উদ্দেশ্য!

ইয়াল লিখেছেন, যেসব প্রযুক্তি পণ্য আমরা এখন ব্যবহার করি তা ‘আসক্তি’ না হলেও এক ধরনের বাধ্যতামূলক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে আমাদের জীবনে! একটু পরপর নতুন মেসেজ দেখার তাড়না আমরা বোধ করি। ইউটিউব, ফেসবুক বা টুইটারে ৫ মিনিটের জন্যে ঢুকে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দেয়া এখন হামেশাই ঘটছে! আর এর কোনোটাই ঘটনাচক্রে ঘটে নি! পুরো ব্যাপারটাই একদল ডিজাইনারের সুচিন্তিত গবেষণার ফসল!

সূক্ষ্ম সব মনস্তাত্ত্বিক কৌশল!

নির ইয়াল তার বইতে কিছু সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের কথা লিখেছেন। যেমন, ভ্যারিয়েবল রিওয়ার্ডস! একজন মানুষ যদি প্রতিনিয়তই তার পছন্দের জিনিস পেতে থাকে, সেটার প্রতি তার আকর্ষণ সেভাবে থাকে না। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন সে পায়, প্রত্যাশা ছাড়া আকস্মিকভাবে পায়, তখন তার আকর্ষণের মাত্রা বেড়ে যায় অনেক! প্রযুক্তি ডিজাইনাররা এ কৌশলকেই কাজে লাগান। যেমন, ‘লাইক’। নানাজনের কাছ থেকে পাওয়া লাইকগুলো একজন ব্যবহারকারী কিন্তু সাথে সাথেই দেখতে পায় না। অ্যাপ-ডিজাইনটাই এমনভাবে করা হয় যাতে প্রথমে এসে এগুলো কোথাও জমে। তারপর ব্যবহারকারীর মুড বুঝে সেটা তাকে দেখানো হয়! ফলে যা হওয়ার তাই হয়। প্রচণ্ডভাবে উদ্দীপ্ত হয় বিশেষ ঐ ব্যবহারকারীর আবেগ, উত্তেজনা! পরিণামে সে বারবার ফিরে আসে ঐ অ্যাপটিতে।

আরেকটি কৌশল হলো মানুষের নেতিবাচক আবেগকে নিয়ে খেলা! একজন মানুষ যখন নিঃসঙ্গ থাকে, বিষণ্ন বা হতাশ বোধ করে, দ্বিধাগ্রস্ত বা বিরক্ত থাকে অথবা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, সেসময়গুলোতে তার আচরণ বা সিদ্ধান্তগুলো খুব ভেবেচিন্তে হয় না। অস্থিরতা বা অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে সে হয়তো মুহূর্তের আবেগ বা খেয়ালিপনার বশবর্তী হয়েই কিছু একটা করে ফেলে বা বলে ফেলে! আয়াল বলেন, প্রযুক্তি ডিজাইনাররা এসব দুর্বল মুহূর্তেরই সুযোগ নেয়। বিষণ্নতা, একঘেয়েমি বা অন্যের মতামতের মুখাপেক্ষী মুহূর্তগুলোতে ‘লাইক’ বা এ জাতীয় ফিচারগুলোর ব্যবস্থা করে দেয় যা তাকে এসব সময়ে বেশি বেশি করে এগুলো ব্যবহারে প্রলুব্ধ করে।

আরো ভয়ংকর হলো, এসব ডিজাইন কিন্তু গৎবাধা, সবার জন্যে একই স্টাইল করা হয় না! বরং বিশেষ এলগরিদমের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষকেই এরা টার্গেট করে আলাদা আলাদাভাবে! কিছুদিন আগে ফেসবুকের একটি ফাঁস হয়ে যাওয়া গোপন রিপোর্ট থেকে দেখা যায়,  ফেসবুকের একজন কিশোর ব্যবহারকারী কখন মানসিক অনিশ্চয়তায় ভুগছে বা কখন বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছে, ফেসবুক তা ঠিক ঠিক ধরতে পারছে এবং সে অনুযায়ী তাকে ‘কনফিডেন্স বুস্ট’ দিচ্ছে!

স্মার্টফোন আর জুয়ার মেশিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই!

জে ফগের আরেক ছাত্র ট্রিস্টান হ্যারিস। গুগলের প্রাক্তন প্রডাক্ট ম্যানেজার। ট্রিস্টান হ্যারিস অবশ্য নির ইয়ালের মতো শোষকের শোষণ প্রক্রিয়ার পুরো সহযোগী হয়ে যান নি। স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে তিনিও পড়েছেন। বিজে ফগের পারসুয়েসিভ টেকনোলজি ডিজাইন ক্লাসে তিনিও অংশ নিয়েছেন। মাস্টার্সে থাকতে থাকতেই গড়ে তোলেন নিজের একটি সফটওয়ার কোম্পানি।  কিন্তু বছর চারেক পর বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান গুগল তাকে নিয়ে নেয়, দায়িত্ব দেয় প্রডাক্ট ম্যানেজারের। জিমেইলের যে ইনবক্স ডিজাইনটি এখন আমরা দেখি, তা হ্যারিসেরই করা।

কিন্তু কাজ করতে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই হ্যারিস হাঁপিয়ে উঠলেন। মনে হলো, এ কি করছেন তিনি! সেই গুটিকয় প্রযুক্তিবিদেরই তো একজনে পরিণত হয়েছেন তিনি, যাদের করা ডিজাইনগুলোই আজ ঠিক করছে, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ কীভাবে সময় কাটাবে!

হ্যারিস ভেবে দেখলেন, এভাবে তো চলতে পারে না। একটা কিছু বিহিত করা দরকার! এরপর রাতদিন খেটে তিনি লিখলেন ১৪৪ পৃষ্ঠার এক বিশাল প্রেজেন্টেশন- ‘A call to minimize distraction and respect user’s attention by a concerned Product Manager & Entrepreneur’. তার এই প্রেজেন্টেশনটির মূল বিষয় ছিল, প্রযুক্তির নামে বিক্ষিপ্ততা সৃষ্টিকারী অ্যাপ এবং মেইল ডিজাইনগুলো যে আসলে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য, হৃদ্যতা- এসবকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, বারটা বাজাচ্ছে ছোট ছোট বাচ্চাদের মনোযোগ ক্ষমতার- সেই বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

রিপোর্টটি গুগলের ভেতরে বেশ আলোচনা-পর্যালোচনার জন্ম দেয়। এমনকি ল্যারি পেজ, গুগলের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, তিনিও বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন এটার ব্যাপারে। যদিও শেষ পর্যন্ত, কাজের কাজ কিছুই হয় নি। হ্যারিসের এই সচেতনতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা গুগলের ভেতরে কোনো সফলতারই মুখ দেখে নি।

তিন বছর কাজ করার পর গুগল ছেড়ে দেন হ্যারিস। এখন তার প্রধান কাজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে উদ্যোক্তা এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে পণ্য নির্মাণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে, সেই বিষয়ে জনমত সৃষ্টি এবং শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের জন্যে নয়, মানুষের কল্যাণচিন্তাকেও যাতে তারা গুরুত্ব দেয়, সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বোঝানো।

ট্রিস্টান হ্যারিস বলেন, “স্মার্টফোন আর জুয়ার মেশিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই মানুষকে এক ধরনের আশা-নিরাশার দোলাচোলে রাখে। একজন মানুষ যখন জুয়ার মেশিনের হাতল ঘোরায়, তখন কিন্তু সে জানে না যে, তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে! হতে পারে সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা সে পাবে, হতে পারে সে কিছুই পেল না। আর দুরু দুরু বক্ষের এই অনিশ্চয়তার জন্যেই জুয়া মানুষের কাছে এত জনপ্রিয়! স্মার্টফোনও তাই। নোটিফিকিশেন আইকনটা যখন সে দেখছে, তখনও কিন্তু সে জানে না, এটা খুললে সে কী দেখতে পাবে। নতুন কোনো মেইল তার জন্যে অপেক্ষা করতে পারে, নতুন লাইক পড়তে পারে, অথবা একেবারে কিছুই না দেখতে পারে। আর সেজন্যেই স্মার্টফোনকে ঘিরে আমাদের এত আসক্তি!

ট্রিস্টান হ্যারিস সেই গুটিকয় প্রযুক্তিবিদের একজন, যিনি প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন যে, আমাদের স্মার্টফোনের প্রোগ্রামিং করছে যে কোম্পানিগুলো, তারা তাদের সমস্ত শ্রম, মেধা, মনোযোগ ঢেলে দিচ্ছে শুধুমাত্র এটা নিশ্চিত করার জন্যে যে আমরা এ ফোনটাতে আসক্ত হয়ে থাকব।

লাইক, ইমোজি, ফলোয়ার আর স্ট্রিকস- জুয়ার পুরস্কার!

ট্রিস্টান হ্যারিস বলেন, জুয়াখেলায় জিতে গেলে যেসব পুরস্কার মানুষ পায়, ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামের ‘লাইক’ এবং টুইটারের মনোলোভা ইমোজি আর ‘নতুন ফলোয়ার’ অনেকটা সেরকমই! এবং এগুলোর কোনটা দিয়ে কীভাবে একজন মানুষকে দীর্ঘক্ষণ ধরে আটকে রাখা যাবে, তার বিস্তারিত নিয়ে তৈরি করা আছে পরিকল্পিত ছক!

যেমন ধরুন, স্ন্যাপচ্যাট। টিনএজারদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এই অ্যাপটি এখন ব্যবহার করছে পৃথিবীর প্রায় ১৬ কোটি মানুষ। আপনি যদি স্ন্যাপচ্যাটের ‘স্ট্রিকস’ ফিচারটি দেখেন, তাহলেই ব্যাপারটা বুঝবেন। স্ন্যাপচ্যাটে আপনি কার সাথে কতদিন মেসেজ আদান-প্রদান করলেন ‘স্ট্রিকস’ ফিচারটি সেটারই হিসাব দেখায়। তো ছোট ছেলেমেয়েরা যারা এটা ব্যবহার করে তারা ভাবে, “ওহ! অমুকের সাথে আমার ৬৪৩ দিন মেসেজ আদান প্রদান হয়েছে। আর ক’দিন হলেই ১০০০। এটা মিস করা যাবেই না।” ফলে বাবা-মায়ের সাথে কয়েকদিনের জন্যে যখন তারা বাইরে যায়, তখন সমবয়সী আরো ৫ জনের কাছে তার একাউন্টের পাসওয়ার্ড দিয়ে যায়, যাতে তার হয়ে তার বন্ধুরা স্ট্রিকস কাউন্ট বাড়াতে থাকে। এখন আপনি বলুন, এরকম অ্যাপ যারা ডিজাইন করেছে, তাদের উদ্দেশ্য কি মানবকল্যাণ ছিল? না কি ছিল মানুষকে এটা ব্যবহারে আসক্ত করে ফেলা?

‘পুল টু রিফ্রেশ’- আরেক কৌশল!

লরেন ব্রিচটার, টুইটারের বহুল জনপ্রিয় ‘পুল টু রিফ্রেশ’ ফিচারের উদ্ভাবক। নিজের তৈরি অ্যাপ টুইটি’র জন্যে এ ফিচারটা বানানোর মূল কারণ ছিল আসলে অ্যাপটি ‘রিফ্রেশ’ করার সুযোগ তিনি আর কোথাও দিতে পারছিলেন না। যাই হোক, ‘পুল টু রিফ্রেশ’ ফিচারটা এত জনপ্রিয় হলো যে, ২০১০ সালে টুইটার যখন টুইটিকে কিনে নিল, তখন এ ফিচারটি তারা নিল শুধু নয়, আজ পর্যন্ত টুইটারের জনপ্রিয়তম ফিচার হিসেবে এটা রাজত্ব করছে! লরেন ব্রিচটার বলেন, এটা খুবই আশ্চর্য যে, এখনকার সময়ে অ্যাপগুলো যখন নিজে নিজেই আপডেট হতে পারে, তখনও এ ফিচারটি টিকে আছে। আসলে এর সাথে জুয়ামেশিনের খুব ঘনিষ্ঠ একটা যোগ আছে। জুয়াড়িদের যদি জুয়ামেশিনের হাতলটা ঘোরাতে দেয়া না হতো, জুয়ার এত আকর্ষণ থাকতো কি না সন্দেহ। পুল টু রিফ্রেশের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে।

ডোপামিন হিট

জাস্টিন রোজেনস্টাইন, লিয়া পার্লম্যান- নামগুলো সিলিকন ভ্যালির কয়েকটি পরিচিত নাম। ২০০৭-২০০৯ সময়টায় ফেসবুককে আকর্ষণীয় ডিজাইনে গড়ে তোলার কাজে যেসব তরুণ প্রোগ্রামার দিবানিশি কাজ করেছে, এরা তাদের দলের। এসব ডিজাইনের একটি ছিল ‘লাইক’। নিজের পছন্দকে জানানো বা অন্যের পছন্দ পাওয়ার ফেসবুকের এই ফিচারটি এত ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল যে, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ প্রায় সব সোশাল মিডিয়া কোম্পানিই একই ধরনের ফিচার অ্যাড করল তাদের অ্যাপে।

আসলে এই জনপ্রিয়তার পেছনে কাজ করেছে মানুষের মনোজগতের কার্যকারণ! মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামে এক ধরনের কেমিকেল নিঃসরণ ঘটে প্রতিনিয়ত। কিন্তু হঠাৎ যদি এমনকিছু ঘটে যা প্রত্যাশার চেয়েও ভালো, তখন আকস্মিকভাবে বেড়ে যায় এই ডোপামিনের প্রবাহ এবং ভালো লাগাকে আরো বাড়াতে ব্রেন তখন ঐ কারণটাকেই আরো বাড়াতে বলে।

ফেসবুক, টুইটার বা ইনস্টাগ্রামের ‘লাইক’ এ ব্যাপারটাই ঘটায়। লাইক পাওয়ার সুখানুভূতি পেতেই বারবার আমরা একই পোস্ট বা কমেন্ট করতে থাকি। দেখতে থাকি, নতুন কী এল!

আর সুচতুরভাবেই যে ডিজাইনারটা এটা করেছেন, তা স্বীকার করলেন ক্রিস মার্সেলিনোও। আইফোনের শুরুর সময়টায় যিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন এর জন্যে নানারকম অ্যাপ ও ডিজাইন কৌশল গড়ে তুলতে। আজ একটা ‘উবার’ ডাকা থেকে শুরু করে নতুন কোনো খবর পড়া অবধি সবকিছুর জন্যেই যেসব অ্যাপের ওপর আমরা নির্ভরশীল!

নোটিফিকেশন ডিজাইনটি কেন লাল?

সাধারণত দেখবেন, যে-কোনো অ্যাপের নোটিফিকেশন ডিজাইন কালারটি লাল। ফেসবুক থেকেই এটা শুরু হয়। ফেসবুকে কাজ করতেন ট্রিস্টান হ্যারিসের এমন একজন বন্ধু তাকে একবার বলেছিলেন, নতুন কোনো নোটিফিকেশন এলে ফেসবুকের যে ডিজাইনের মধ্যে তা দেখাবে, প্রথমদিকে এর রঙটা ছিল নীল। কারণ সবার মত ছিল, ফেসবুকের অফিসিয়াল রঙের সাথে এটাই হবে মানানসই। তো পরীক্ষামূলকভাবে এই ডিজাইনে ছেড়ে দেয়া হলো ফেসবুকের নিজস্ব কর্মীদের একটা গ্রুপের মধ্যে। দেখা গেল, কেউ এটাতে সেভাবে যাচ্ছে না। এরপর করা হলো লাল। তখন প্রত্যেকেই যেতে লাগল। কারণ নীলের চেয়ে লাল অনেক বেশি উত্তেজিত আর প্রলুব্ধ করে মানুষকে!

এগুলো কোনো ‘নিরপেক্ষ প্রযুক্তিপণ্য’ নয়

প্রযুক্তি সম্বন্ধে একটা কথা বলা হয় যে, এটা না কি নিরপেক্ষ। যিনি যেভাবে ব্যবহার করবেন, সেভাবে ফল পাবেন। প্রশ্ন হলো, তাহলে যারা এগুলো তৈরি করেছেন, তারা নিজেরা কেন এগুলো থেকে বেঁচে থাকার জন্যে এত মরিয়া হবেন?

জাস্টিন রোজেনস্টাইন –ফেসবুকের ‘লাইক’ ফিচার নিয়ে কাজ করেছে যে টিম, তিনি তার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ‘লাইক’ এর সর্বনাশা প্রভাব সম্পর্কে তাই তার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না, তা বলাই বাহুল্য! রোজেনস্টাইন নিজের ল্যাপটপের অপারেটিং সিস্টেমটাকে এমনভাবে সেট করে রেখেছেন যাতে রেডিট নামে একটি সোশাল মিডিয়া সাইটে তা ঢুকতেই না পারে। স্ন্যাপচ্যাটকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘হেরোইন’ বলে। আর সম্প্রতি একটি নতুন আইফোন কিনে তার সহকারীকে বলেছেন, এখানে ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ সেট করে দিতে। যাতে চাইলেও নতুন কোনো অ্যাপ তিনি ডাউনলোড করতে না পারেন।

একই কাজ করেছেন ফেসবুকের সাবেক প্রডাক্ট ম্যানেজার লিয়া পার্লম্যানও। ‘লাইক টিম’ এর তিনিও একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালে তার ব্লগ থেকেই ‘লাইক’ ফিচারের ঘোষণাটি এসেছিল। ফেসবুকে কাজ করতে করতে পার্লম্যান এতটাই হাঁপিয়ে উঠেছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত পেশাই পরিবর্তন করে ফেলেছেন! পার্লম্যান এখন আর কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার নন। তিনি এখন একজন ইলাস্ট্রেটর! ছবি আঁকেন। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা লাভ করেছেন। ছবির মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন ধর্মের  নৈতিক আর মানবিক বাণীগুলো। ফেসবুকের নিউজ ফিড বন্ধ রাখার জন্যে পার্লম্যানের ফোনে আছে বিশেষ একটি ওয়েব ব্রাউজার প্লাগ ইন। আর ফেসবুকে তার নিজের পেজটা দেখভাল করার জন্যে পয়সা দিয়ে ভাড়া করেছেন একজন সোশাল মিডিয়া ম্যানেজারকে! কারণ? যাতে নিজে ব্যবহার করতে গিয়ে এতে আসক্ত হয়ে না যান!

এ ঘটনাগুলো একটা ইঙ্গিতই দেয়! আর তাহলো এসব প্রযুক্তি পণ্য যারা তৈরি করেছে, তারা সচেতনভাবেই এগুলোতে ব্যবহার করেছে নানারকম আসক্তি সৃষ্টিকারী কৌশল যার লক্ষ্য হলো মানুষকে আসক্ত করে এ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া।

মনোযোগ দখলের লড়াই!

ট্রিস্টান হ্যারিস বলেন, ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আসলে একটা মনোযোগ দখলের লড়াই! প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা যে কে কার চেয়ে বেশি মনোযোগ ধরে রাখতে পারে ব্যবহারকারীদের। এবং এটার জন্যে তার যা যা করা দরকার সে তা করবে! তাতে আপনার কল্যাণ-অকল্যাণ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম নেই। ধরুন, ইউটিউব। ভিডিও এই অ্যাপটিতে একটা কিছু দেখা শেষ হওয়ামাত্রই দেখবেন একগাদা নতুন ভিডিও সাজেস্ট করছে। আপনি দেখতে চান কি না, আপনার সেই মতামতের কিন্তু কোনো সুযোগ নেই এখানে! ট্রিস্টান হ্যারিস বলেন, কল্যাণকামী প্রডাক্ট ডিজাইনের নীতি তো এমন হবে না কখনো!

আবার মনোযোগের লড়াইয়ে জেতার জন্যে কোম্পানিগুলো এখন যে-কোনো কিছু করতে মরিয়া! ধরুন, ইউটিউবের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কে? হয়তো ফেসবুক। কেন? কারণ মানুষটি যখন ফেসবুকে আছে, তখন তো ইউটিউব দেখতে পারছে না! তো এ  এমনকি সেটার জন্যে যদি আপনার ঘুম কেড়ে নিতে হয়, তাহলে তা-ও। কিছুদিন আগে নেটফ্লিক্স- আমেরিকার বড় একটি বিনোদন কোম্পানির সিইও তার এক বক্তব্যে বলছিলেন, নেটফ্লিক্সের প্রতিদ্বন্দ্বী হলো তিনজন- ১. ইউটিউব ২. ফেসবুক ৩. ঘুম

কারণ তারা দেখছে যে, প্রতিটি মানুষের সময় হচ্ছে সীমিত। এই সময়টা সে সেখানেই দেবে, যেখানে সে বেশি আকর্ষণ বোধ করবে। মানুষের সীমিত সময়ের ভাগ পাওয়ার জন্যে তাই চলছে তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি। লড়াইটা তাই কে কার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়, আসক্তিকর পণ্য তৈরি করতে পারে, সেখানে! কাজেই যে ফোনটা হাতে নিয়ে আপনি বসে আছেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন, এ মুহূর্তে এই ফোনটার অপরপ্রান্তে বসে হাজারেরও বেশি প্রযুক্তিবিদ অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছে, কীভাবে আরো বেশি সময় ধরে আপনাকে ফোনে বসিয়ে রাখা যায়।

ব্রেন হ্যাকার

“ব্রেন হ্যাকার হলো এমন একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার যে মস্তিষ্কের কার্যকারণ সম্পর্কে জানে এবং সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এমন ধরনের কম্পিউটার কোডিং করতে পারে, যার মাধ্যমে সে ব্যবহারকারীর মস্তিষ্ককে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করাতে পারবে।-” কম্পিউটার প্রোগ্রামার রামজি ব্রাউন এভাবেই ‘ব্রেন হ্যাকার’ এর সংজ্ঞা দিল। ক্যালিফোর্নিয়ার ভেনিসে নিজের সফটওয়ার ফার্মে সহকর্মীদের নিয়ে সে ধরনের অ্যাপ বানানোই তার পেশা যা মানুষকে বার বার অ্যাপগুলোতে লগ ইন করতে প্রলুব্ধ করবে।

লক্ষ করার মতো বিষয় হলো, কম্পিউটার প্রোগ্রামার হলেও নিউরোসায়েন্স নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করেছে রামজি। নিজের সফটওয়ার ফার্মের নাম সে দিয়েছে ‘ডোপামিন ল্যাব’- মস্তিষ্কের একটি বিশেষ উদ্দীপক হরমোনের নামে, মানুষের কামাসক্তিকে যা উসকে দেয়। আর এ নামকরণ সার্থক। কারণ রামজি যেসব অ্যাপ বানায়, তার প্রতিটিরই উদ্দেশ্য থাকে, মানুষের মস্তিষ্ককে এমনভাবে উদ্দীপ্ত করা, উসকে দেয়া যাতে সে এটাতে ‘আসক্ত’ হয়ে থাকবে।

ব্যবহারকারীরা আসলে ‘গিনিপিগ

রামজি এবং তার সহকর্মীরা এমন সব কম্পিউটার কোড ডিজাইন করে থাকে, যার কাজ হলো সেই মোক্ষম সময়টা খুঁজে বের করা, যখন স্মার্টফোন নামক জুয়ামেশিনের পুরস্কারগুলো সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করবে ব্রেনকে! রামজি ইনস্টাগ্রামের ‘লাইকসংখ্যা’র উদাহরণ দিল। “খেয়াল করলে দেখবেন, ইনস্টাগ্রামে হঠাৎ হঠাৎ যেন আপনার লাইকের বন্যা বয়ে যায়! কেন? কারণ আমরা এমনভাবে কোডিং করি, যাতে প্রথমদিকে লাইকগুলো এসে একটা কোথাও জমা হতে থাকে। আমাদের এলগরিদম এমনভাবে করা থাকে যে, এরপর একটা মোক্ষম সময় বুঝে আমরা সেটা ছেড়ে দিই।”

এদিকে ব্যবহারকারী তখন দেখে যে, একসাথে তার হয়তো ৩০টি লাইক এসে গেছে! সে তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়! ভাবে, ওরে বাবা! একসাথে এত লাইক! ফলে সে আরো বেশি লাইক পাওয়ার জন্যে করতে থাকে নানান কারবারে! অথচ সে জানতেও পারছে না যে, পুরো ব্যাপারটাই অলক্ষে বসে ঘটাচ্ছে রামজির মতো ব্রেনহ্যাকাররা। এবং সে আসলে তাদের এক্সপেরিমেন্টেরই একটা সাবজেক্ট মাত্র। যে এক্সপেরিমেন্টটির নম্বর হয়তো ২৩১ এবং সেখানে তার পরিচয় স্রেফ আরেকটি নাম্বারের- ৭৯বি৩। তার মানে, সে আসলে গিনিপিগ ছাড়া আর কিছু নয়! যে গিনিপিগদের রামজিরা বাক্সবন্দি করে রেখেছে, অনবরত তাদেরকে দিয়ে এসব অ্যাপের বোতাম টেপাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে ব্যবস্থা করছে কিছু ‘লাইক’ পাইয়ে দেয়ার!

গুটিকয় অ্যাটেনশন ইঞ্জিনিয়ারই আজ নিয়ন্ত্রণ করছে কোটি মানুষের মস্তিষ্ক!

স্মার্টফোনের নেশা ধরিয়ে দেয়া অ্যাপগুলো যারা তৈরি করেন, তারা বেশিরভাগই সিলিকন ভ্যালির খুব তুখোড় প্রোগ্রামার। যাদের আরেকটি পরিচয় হলো ‘অ্যাটেনশন ইঞ্জিনিয়ার’। মানুষের মনোযোগ এবং আকর্ষণকে প্রলুব্ধ করার জন্যে যারা লাস ভেগাসের জুয়া-আসরের ফন্দিগুলো যেমন খাটান, তেমনি প্রয়োগ করেন গেমিফিকেশনের কৌশল- ভিডিও গেমের মজাদার এবং প্রতিযোগিতামূলক উপাদানগুলোকে স্মার্ট ফোনের কনটেন্টে ঢোকানো। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো যুগেই এরকম হয় নি যে, ক্যালিফোর্নিয়ার মাত্র তিনটি টেক কোম্পানিতে কর্মরত ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী গোটা পঞ্চাশেক তরুণ প্রোগ্রামার নেপথ্যে বসে যা করছে, তা-ই ঠিক করে দিচ্ছে পৃথিবীর শত কোটি মানুষ কীভাবে তাদের সময় কাটাবে! বিজ্ঞানীরা বলেন, জুয়ার আসরে কেউ গেলে যেমন তার বিপদের কথা ভেবে আমরা আতংকিত হই, স্মার্ট ফোনের বিপদ তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি। কারণ সারাক্ষণই সে-তো ঘুরছে স্মার্ট ফোন নামের ঐ জুয়োর মেশিনটা নিয়ে।

প্রযুক্তি স্রষ্টারা ব্যবহার করছেন না!

‘প্রযুক্তি পণ্য মানুষের নেশা ধরিয়ে দেয়’ এ অভিযোগ যদি মিথ্যা হতো, তাহলে যারা এ পণ্যগুলোর স্রষ্টা, তারা নিজেরা কেন এটা ব্যবহার করছেন না? বা তাদের সন্তানদের ব্যবহার করতে দিচ্ছেন না?

জাস্টিন রোজেনস্টাইন আর লিয়া পার্লম্যানের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এদের কাতারে শামিল হয়েছেন লরেন ব্রিচটার বা চামাথ পালিহাপিতিয়ার মতো প্রযুক্তিবিদরাও।

লরেন ব্রিচটার টুইটারের জনপ্রিয় পুল টু রিফ্রেশ ফিচারের উদ্ভাবক। ব্রিচটার বলেন, আমি জানি না, দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর ধরে আমি যেসব কাজ করেছি, তার কতটুকু মানুষের কল্যাণে লেগেছে। নিজের কম্পিউটার থেকে অনেকগুলো সাইটকে তিনি ব্লক করে রেখেছেন। টেলিগ্রাম নামের অ্যাপটিতে স্ত্রী আর ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধু ছাড়া বাকি সবাইকে সরিয়ে ফেলেছেন এবং নিজেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন টুইটার থেকে! নিজের ফোনটা তিনি সেই যে সন্ধ্যা ৭টায় রান্নাঘরের সুইচবোর্ডে চার্জে দিয়ে সরে পড়েন, হাতে নেন আবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে।

ফেসবুকের সাবেক নির্বাহী চামাথ পালিহাপিতিয়া। ২০০৬ থেকে ফেসবুকে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির মূল ক্রীড়নক ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে এটা ব্যবহার করেন না। ১০ বছরে সর্বোচ্চ ৬-৭টা পোস্ট তিনি দিয়েছেন। মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুক একাউন্ট দেখভালের জন্যে রয়েছে ১২ জন সহকারী।

কারণ তারা জানেন, এসব পণ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে। ২০১৭ এর ডিসেম্বরে ফেসবুকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট শন পার্কার বলেন, ফেসবুকসহ এজাতীয় সব সোশাল মিডিয়াগেুলোতেই আমরা খুব সচেতনভাবে সেসব টেকনিকগুলোই ব্যবহার করেছি যা হবে মানুষের মনোযোগ এবং সময়খাদক। তাইত কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে এসব আসক্তির দিকে ঠেলে দিলেও নিজেদের সন্তানদের সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন এসব ব্যবহার থেকে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনকুবের বিল গেটস। তার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট সারা পৃথিবীর কম্পিউটার জগৎ দোর্দন্ড প্রতাপে শাসন করছে। অথচ তার সন্তানরা দিনে ৪৫ মিনিটের বেশি কম্পিউটার ব্যবহার করার সুযোগ পায় না। কেবল তা-ই নয়, সন্তানদের বয়স ১৪ হবার আগে বিল গেটস স্মার্টফোন তো দূরের কথা, মোবাইল ফোনই কিনে দেন নি।

আইফোন ও আইপ্যাডের নতুন মডেল বাজারে আসার আগেই অনলাইনে লাখ লাখ পিস আগাম বিক্রি হয়ে যায়। যে গ্যাজেট নিয়ে এত মাতামাতি, তার নির্মাতা অ্যাপলের কর্ণধার স্টিভ জবস কিন্তু তার সন্তানদের আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেন নি। আই প্যাড যখন বাজারে এল, স্টিভ জবসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার সন্তানরা কি এটা পছন্দ করেছে? স্টিভ জবস তখন উত্তর দিয়েছিলেন, না, ওরা এটা ব্যবহার করে নি। আমাদের সন্তানরা কতটা প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করবে, তার সীমা আমরা বেঁধে দিই।

দুমুখো নীতি অবলম্বনকারী এসব প্রযুক্তি মাফিয়াদের অবস্থানটা আসলে ড্রাগ ডিলারের! ড্রাগ ডিলাররা যেমন নিজেরা না হয়ে মানুষকে ড্রাগে আসক্ত করে, এরাও তেমনি। যেসব প্রযুক্তি পণ্য বানিয়ে এরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে, নিজেদের সন্তানদের তারা বড় করছে সেসব ছাড়াই! সিলিকন ভ্যালির নামজাদা সব টেকনোলজিস্টদের সন্তানরা সেখানকার অভিজাত এমন সব স্কুলে যায়, যেখানে আইফোন, আইপ্যাড তো দূরের কথা, ল্যাপটপ পর্যন্ত নিষিদ্ধ!

‘ব্যবসা’ই মূল উদ্দেশ্য

আর এই পুরো বিষয়টাই ঘটছে ব্যবসাগত কারণে, অর্থলাভের স্বার্থে। জুয়া আসরের মূল লাভ যেমন যায় আসরের আয়োজনকারীদের পকেটে, তেমনি স্মার্টফোন আর এর নেশা ধরিয়ে দেয়া অ্যাপগুলোতে মানুষকে আটকে রাখার ফলেও লাভবান হয় সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোই। কারণ যত বেশি আপনি স্ক্রিনে থাকবেন তত আপনার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া তার জন্যে সহজ হবে এবং তত আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বাড়বে তার রোজগারের সুযোগ!  আপনি হয়তো ভাবছেন, আপনি তো ফেসবুক ব্যবহার করছেন ফ্রি। কতরকম সুবিধাদি পাচ্ছেন কোনো খরচ না করেই। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো সমাজসেবা করতে নেমেছে! তারা এটা করতে পারছে, কারণ বড় বড় বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ তারা হাতিয়ে নিয়েছে আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখানোর বিনিময়ে।  সোশাল মিডিয়াগুলোতে মানুষ আজকাল এত বেশি ব্যক্তিগত তথ্য দেয় যে, এসব থেকে একটি মানুষের রুচি, পছন্দ, আর্থিক সামর্থ্য, জীবনযাপন পদ্ধতি- ইত্যাদির প্রায় নির্ভুল চিত্রাংকন সম্ভব। ফলে সে মানুষটিকে একেবারে তার মোক্ষম পছন্দের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে সম্ভব তাকে দিয়ে তা কেনানো।

ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার এটাই নিয়ম!

আর ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার এটাই নিয়ম। মানুষকে ভোগে প্রলুব্ধ করে যাদের স্বার্থ হাসিল হবে, তারা তো কখনো আপনার কল্যাণ নিয়ে ভাবতে চাইবে না। কারণ কল্যাণ নিয়ে ভাবতে গেলে, তারা এখন যা করছে, সেটা করতে পারবে না। অর্থ আয়ের কোনো সুযোগ তো তাদের থাকবে না। ফলে যে ব্যবস্থা চলছে, তা পরিবর্তনে তারা উদ্যোগী হবে- এমনটা আশা করাও বৃথা!

Comments (0)
Add Comment