আস্ত বস্ত্রটি দেশলাইয়ের বাক্সের মধ্যে রাখা-এমন কথার সমার্থক হয়ে আছে ঢাকার মসলিন। অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে জগৎজোড়া প্রসিদ্ধি এই মসলিন। মোগল রাজদরবারে মসলিনের ব্যাপক সমাদর ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গিয়েছিল সেই মসলিন। বর্তমানে এটিকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন গবেষক দল।
বাঙালির হারানো গৌরবমাখা এক ঐতিহ্যের নাম মসলিন। মসলিন কাপড় তৈরির মূল উপকরণ ফুটি কার্পাস তুলার আঁশ। এই আাঁশ থেকে প্রস্তুতকৃত সুতা দিয়ে তৈরি করা হতো অতি সুক্ষ কাপড়। যা সবার কাছে ঢাকাই মসলিন নামে পরিচিত ছিলো।
ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে প্রস্তুত অতি চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হতো। চড়কা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হতো, যার ফলে মসলিন হতো কাচের মত স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার হতো।
মসলিন প্রায় ২৮ রকমের হতো। যার মধ্যে জামদানী এখনও ব্যাপক আকারে প্রচলিত। নানা কারণে আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলায় মসলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
মসলিন প্রস্তুত করা হতো বাংলার সোনারগাঁও অঞ্চলে। কথিত আছে যে, মসলিনে তৈরি করা পোশাক সমূহ এতই সুক্ষ ছিল যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেত।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, ১৮৫৬ সালের পর আমাদের দেশে আর ঢাকাই মসলিন কাপড় তৈরী হয়নি। এ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কারো ছিল না কোনো নজর।
হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিনকে ফিরিয়ে আনতে নজর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর পরিকল্পনায় ২০১৪ সালে মসলিন ফিরিয়ে আনতে নির্দেশনা মোতাবেক কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালে চালু করেছিলেন সোনালী মসলিন তৈরীর প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার প্রকল্প। সরকারের প্রচেষ্টা ও দেশের গবেষকদের কঠোর পরিশ্রমে মসলিন কাপড় উৎপাদন সক্ষম হয়।
এখন গবেষকদের চেষ্টায় চলছে মসলিন কাপড় তৈরীর মূল উপকরণ ফুটি কার্পাস তুলা চাষ সম্প্রসারণ নিয়ে গবেষণা। ইতোমধ্যেই তৈরী হয়েছে সম্ভাবনা। গবেষকদের আশা ধাপে ধাপে আমাদের দেশ মসলিন কাপড় উৎপাদনে পথে এগিয়ে যাবে।
কাপাসিয়ায় যেভাবে মেলে ফুটি কার্পাসের খোঁজ: এ প্রকল্পের অন্যতম গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন। সম্প্রতি কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই ছিল আমার দলটির প্রধান কাজ। কিন্তু হাতে কোনো মসলিন কাপড়ের নমুনা নেই, নেই ফুটি কার্পাসের কোনো চিহ্নও। ছিল শুধু সুইডস গবেষক ক্যারোলাস লিনিয়াসের লেখা স্পেসিস প্লান্টেরাম, আবদুল করিমের ঢাকাই মসলিন এর মতো কিছু বই। এর মধ্যে ক্যারোলাস লিনিয়াসের বইতে মসলিন কাপড় বোনার জন্য ফুটি কার্পাস উপযুক্ত বলে উল্লেখ ছিল। এই গাছ পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে চাষ হতো বলে সেখানে লেখা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ফুটি কার্পাস বাংলাদেশের কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে এমন ধারণার ওপর ভিত্তি করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি টেলিভিশনেও প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস দেন। এটা দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকার একটি কলেজের অধ্যক্ষ মো. তাজউদ্দিন ফুটি কার্পাসের সন্ধান চেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল কলেজে প্রচারপত্র বিলি করেন এবং মাইকিং করেন।
২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। গবেষকেরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক, বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে নেওয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কান্ড ও ফুল। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান।
এছাড়াও দীর্ঘদিন পরিশ্রমের পর বিদেশের জাদুঘরে থাকা মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করেন। গবেষকেরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহিত কাপাসিয়ার ফুটি কার্পাস গাছের মিল পান অবশেষে। তারা নিশ্চিত হন, সেটিই তাঁদের কাঙ্খিত জাতের ফুটি কার্পাস।
স্থানীয় মাদরাসা শিক্ষক আবদুল আজিজ নামের এক ব্যক্তি এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেওয়া হয়।
এদিকে গাজীপুরের-৪ আসনের সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি উদ্যোগ নেন কাপাসিয়ার সেই হারানো ফুটি কার্পাস চাষ সম্প্রসারনের। তিনি যোগাযোগ করেন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে। কৃষকরা এগিয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর মসলিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ কাপড় উৎপাদনের মূল উপকরণ কার্পাস তুলার যোগানের পথ খুলে দেওয়ার এখন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যা শুরু হয়েছে কাপাসিয়া থেকেই। আর এখন গাজীপুরের, শ্রীপুর, নরসিংদী ও ময়মনসিংহে ফুটিকার্পাসের চাষ হচ্ছে।
সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘ঐতিহাসিকদের মতে, কাপাসিয়ার নামকরণটাই মূলত কার্পাস তুলার সৌজন্যে। মোঘল আমল থেকেই আমাদের দেশের প্রচুর মসলিন কাপড় তৈরী হতো। যার মূল উপকরণ ছিল এ কার্পাস তুলা। তবে একটি সময় মসলিন কাপড় তৈরী বন্ধ হয়ে গেলে এ তুলার চাষও বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তা বিলুপ্তও হয়ে যায়। এখন যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে মসলিন ফিরে এসেছে সেজন্যই মূলত এর চাষ সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা আমরা ঐতিহ্যে ফিরছি। আমাদের কাপাসিয়ায় ঐতিহ্যে ফিরছে। এছাড়াও কৃষকরাও এতে লাভবান হবেন।
এ প্রকল্পের পরিচালক আইয়ুব আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় আবার মসলিন ফিরে এসেছে এটা পুরো জাতীর জন্য একটি ভালো খবর। এখন আমরা মসলিন তৈরীর মূল উপকরণের যোগানের দিকে (ফুটি কার্পাস তুলা চাষ) নজর দিয়েছি। ইতোমধ্যেই ময়মনসিংহের বিজিএমসির জমিতে চার একর, গাজীপুরের তুলা উন্নয়ন বোর্ডের ৭ বিঘা জমিতে, নরসিংদী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিতে ফুটিকার্পাসের চাষ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে কৃষকদের চাষাবাদের উপযোগী করে ফুটিকার্পাসের উন্নত জাত বের করে আনা। আমরা মসলিনকে তার পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
গাজীপুর তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কটন এগ্রোনমিষ্ট কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াহাব বলেন, আমরা সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করেছি ১৬টি ফুটি কার্পাসের জাত। এর মধ্যে মসলিন কাপড় তৈরীর জাতটি পেয়েছি কাপাসিয়া থেকে (এসআর ২৫)। এখন এ জাতটি উন্নত করা নিয়ে গবেষণা চলছে। আমাদের আশা বিভিন্ন জাতের সংমিশ্রনে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা একটি উন্নত জাত সামনে আনতে সফল হবো।
তথ্য মতে, বিলুপ্ত হওয়া ঢাকাই মসলিনের প্রধান উপকরণ এই ফুটি কার্পাস গাছ থেকে উৎপন্ন তুলা। ফুটি কার্পাসের বোটানিক নাম গোসিপিয়াম আরবোরেটাম ভার নেগেøক্টা। এ তুলা খুব সাধারণ কোনো তুলা নয়। এই গাছের পাতা দেখতে অনেকটা মেপলের মতো। প্রতি বসন্তকালে ধূসর পলিমাটিতে এই গাছ জন্মতো। আর পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরের দু’বার হলুদ রঙের ড্যাফোডিলের মতো ফুল হতো। সেই ফুল থেকে পাওয়া যেতো তুষার শুভ্র তুলা।
পৃথিবীতে বর্তমানে যে তুলা উৎপাদিত হয় এর ৯০শতাংশ হচ্ছে মধ্য আমেরিকা থেকে আসা গোসিপিয়াম হিরসুটাম জাতের তুলা। তার আঁশ হচ্ছে সরু ও লম্বা আকৃতির। কিন্তু ফুঁটি কার্পাস থেকে যে তুলা হয় তা খাটো ও মোটা ধরনের। কার্পাস তুলা মেশিনে ব্যবহার করে কাপড় বোনার উপযোগী ছিল না। তবে স্থানীয়রা এ তুলাকেই তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ব্যবহার উপযোগী করে প্রায় ১৬টি বিভিন্ন ধাপ পেড়িয়ে চড়কায় কেটে মাসের পর মাস পরিশ্রম করে ঢাকাই মসলিন বোনার উপযোগী করে তুলতেন।