দেশের মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বেড়ে হয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছর। পুরুষের ক্ষেত্রে গড় আয়ুস্কাল ৭১ দশমিক ১ বছর এবং নারীদের ৭৪ দশমিক ২ বছর। বাংলাদেশের জনসংখ্যা (১ জানুয়ারি ২০২০, প্রাক্কলিত) বেড়ে হয়েছে ১৬ কোটি ৭৪ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৩৮ লাখ এবং নারী ৮ কোটি ৩৬ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস-২০১৯’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশের মোট জনসংখ্যা এবং তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা জানতে প্রতি দশবছর পর পর সারাদেশে আদম শুমারি করা হয়। আর এই তথ্যের সাথে সমন্বয় করতে প্রতিবছর নমুনা সংগ্রহ করে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বিবিএস।
মঙ্গলবার আগাঁরগাস্থ পরিসংখ্যান ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, দেশের শিশু মৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুর হারে উন্নতি হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার হারেও উন্নতি হয়েছে। তবে দেশের মানুষের মাইগ্রেশন (স্থানান্তর) হার বেড়েগেছে অস্বাভাবিক হারে। পরিবারের আকার ছোট হয়ে আসছে, পুরুষেরা আরো কম বয়সে বিয়ে করছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার বাড়ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রকল্প পরিচালক একেএম আশরাফুল হক।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে। উল্লেখ্য ২০১৮ সালের জরিপে পুরুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ছিল ৭০ দশমিক ৬ বছর এবং না রীদের ৭৩ দশমিক ৫ বছর। এবার সেটি হয়েছে পুরুষের ক্ষেত্রে ৭১ দশমিক ১ বছর এবং নারীদের ৭৪ দশমিক ২ বছর।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, উন্নয়নে সঠিক তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাঠ পর্যায় থেকে বিশুদ্ধ তথ্য তুলে আনতে হবে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিসংখ্যা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব বলেন, এই জরিপের মাধ্যমে আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আর্থ-সামজিক অবস্থার পরিমাপ করি। এবারের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আর্থ-সামাজিক অনেক সূচকেই ভারত, পাকিস্তান ও নেপালসহ অনেক দেশ আমাদের পেছনে রয়েছে।
২০১৯ সালে মোট ২০১২টি নমুনা এলাকা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে দেশে খানার গড় সদস্য সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৪ যা ২০১৯ সালে হয়েছে ৪ দশমিক ২ জনে। বাংলাদেশের নারীরা এখনও পুরুষ দ্বারা উচ্চমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত। ৮৫ দশমিক ৪ ভাগ পরিবারের খানা প্রধান হচ্ছে পুরুষ। দেশে বয়স্ক শিক্ষার হার বেড়েছে। ২০১৫ সালে বয়স্ক শিক্ষার হার ছিল ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ এব হার ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশে।
জন্মহার: বাংলাদেশে প্রতি হাজারে স্থুল জন্মহার দাড়িয়েছে ১৮ দশমিক ১ এ, যা ২০১৫ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৮। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে স্থুল জন্মহার কমেছে শুণ্য দশমিক ৭ শতাংশের বেশি। তবে নারীদের প্রজনন হার সাম্প্রতিক বছর গুলোতে প্রায় স্থির (২০.৪) রয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার শতকরা ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশে স্থির রয়েছে।
মরণশীলতা: ২০১৯ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি হাজারে মরণশীতলতা (মর্টালিটি রেট) দাড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯ জনে, যা ২০১৫ সালে ছিল ৫ দশমিক ১ জন। এছাড়া প্রতি হাজার জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুর ক্ষেত্রে মরণশীলতার হার (নিওনেটাল মর্টালিটি রেট) দাঁড়িয়েছে ১৫ জনে যা ২০১৫ সালে ছিল হাজারে ২০ জন। এছাড়া ২০১৯ সালে এক থেকে চার বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার কমে হয়েছে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৭ জনে যা ২০১৫ সালে ছিল ২ জন। অন্যদিকে মাতৃমৃত্যুর হারও কমেছে। এটি গত পাঁচ বছরে সমহারে কমেছে। ২০১৫ সালে মাতৃ মৃত্যুর অনুপাত ছিল ১ দশমিক ৮১, যেটি ২০১৯ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৬৫ এ। গত পাঁচ বছরে প্রত্যাশিত আয়ুস্কাল গড়ে প্রতিবছর শুণ দশমিক ৩৪ বছর হারে বেড়েছে। পুরুষের তুলনায় নারীদের গড় আয়ু বেশি বেড়েছে।
বিবাহের গড় বয়স: প্রতিবেদন অনুযায়ী পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রথম বিবাহের গড় বয়স কিছুটা নিম্নমুখী। যা ২০১৫ সালে ছিল ২৫ দশমিক ৩ বছর। এটি ২০১৯ সালে হয়েছে ২৪ দশমিক ২ বছর। পক্ষান্তরে নারীদের মধ্যে এই বয়স ২০১৫ সালে ছিল ১৮.৪ বছর যা ২০১৯ সালে হয়েছে ১৮ দশমিক ৫ বছর।
আগমন ও বর্হিগম: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে আগমন ও বর্হিগমন উভয়ই অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্যে ফলাফলে প্রতি হাজার জনসংখ্যার মধ্যে আগমন করে ৭২ দশমিক ৪ জন (ইন মাইগ্রেশন রেট)। ২০১৫ সালে এটি ছিল ৫৪ দশমিক ২ জন। বর্হিগমনের ক্ষেত্রে (আউট মাইগ্রেশন রেট) দেখা গেছে, ২০১৯ সালে নমুনা এলাকার প্রতি হাজার জনসংখ্যার মধ্যে বর্হিগমন করে ৭২ দশমিক ৭ জন। ২০১৫ সালে এটি ছিল ৫৪ দশমিক ৪ জন। এক্ষেত্রে শহর এলাকায় আগম ও বর্হিগমন উভয়ই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
শিক্ষা হারের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সাত বছরের উর্ধে জনসংখ্যার মধ্যে এখন শিক্ষার হার ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া ১৫ বছর থেকে তার উপরের জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষার হার ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ। পরিবারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে পরিবারের আলোর উৎস হিসেবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে ৯৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার, যেটি ২০১৫ সালে ছিল ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করে ৮১ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার, যেটি ২০১৫ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ। পানির ব্যবহারে ট্যাপ বা নলকূপ ব্যবহারের আওতায় এসেছে ৯৮ দশমিক ১শতাংশ পরিবার, যেটি ২০১৫ সালে ছিল ৯৭ দশমিক ৯ শতাংশ। বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম হচ্ছে ৮৮ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে ছিল ৮৮ দশমিক ২ শতাংশ। হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মের জনসংখ্যা ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। প্রতিবন্ধির তথ্যে দেখা যায় দেশে প্রতি হাজারে ৮ জন কোন না কোন ভাবে প্রতিবন্ধি। নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে প্রতিবন্ধিতার হার কিছুটা বেশি।