চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের পছন্দের শীর্ষে ভারত। বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। বছরে ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেডিকেল ট্যুরিস্ট বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছেন। এতে তাদের কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের হেলথ কমিটির চেয়ারম্যান ও চার্নক হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত শার্মা।
চিকিৎসাখাতে বাংলাদেশ আকর্ষণীয় স্থান মনে করছেন ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা। এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষাণা এসেছে ডিসান হাসপাতালের পক্ষ থেকে। সামনে বিনিয়োগ আরও বাড়ার সম্ভাবনাসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন প্রশান্ত শর্মা।
বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য আস্থা পায় ভারতে। সেই চিকিৎসাসেবাটা ভারতের হাসপাতালগুলো কতটা নিশ্চিত করতে পারছে?
প্রশান্ত শর্মা: আমার মনে হয় এটা ন্যাচারাল চয়েস। কারণ বাংলাদেশের জন্য ভারত পাশের রাষ্ট্র। আমরা জানি সংস্কৃতি, খাবার নানাবিধ বিষয় আছে। তার চেয়ে জরুরি বিষয় খরচ। একজন রোগী তো একা যায় না। সঙ্গে পরিবারের সদস্য বা বন্ধু যাচ্ছে। তাদের যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া একটা বিরাট খরচ। ধরুন ভারত কিংবা থাইল্যান্ডে একজন রোগীর চিকিৎসা খরচ একশ ডলার। পাশাপাশি ভারতে থাকার খরচ লাগবে ২০ ডলার, থাইল্যান্ডে গেলে সেটা লাগবে দুইশ ডলার এবং সিঙ্গাপুরে গেলে পাঁচশ ডলার। সবমিলে চিকিৎসা ও অন্য খরচ মিলে হিসাব করলে ভারত অনেক সাশ্রয়ী।
বাংলাদেশের কত মানুষ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেন, আপনাদের কাছে কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না?
প্রশান্ত শর্মা: আমাদের হেলথ ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরের মধ্যে ট্যুরিজম ট্রাভেল ৮৪ শতাংশ বেড়েছে। আপাতত ২০২১ সালের তথ্য যেটা বলছে, বছরে ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেডিকেল ট্যুরিস্ট বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসছে। শুধু বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা মানুষ মেডিকেল ট্যুরিজমে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করে। এটা যারা মেডিকেল ভিসা নিয়ে যাচ্ছে তাদের তথ্য। এছাড়া অন্য ভিসাগ্রহীতারাও আছেন।
রাজ্য হিসেবে এই সংখ্যাটা ভাগ করা মুশকিল। এখান থেকে বেশিরভাগ যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ ও তামিল নাড়ু। কিছু অংশ যাচ্ছেন দিল্লি, মুম্বাই। এর মধ্যে দিল্লি ও মুম্বাইয়ে ১০ থেকে ১২ শতাংশ মানুষ যায়। একটা বড় অংশ যায় পশ্চিমবঙ্গ, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী যায় তামিল নাড়ুতে। সেখানে চেন্নাই ও সিএমসি ভেল্লোর। আর বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদেও কিছু মানুষ যাচ্ছে, তবে অন্য রাজ্যের হিসাবে সেই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়।
বাংলাদেশিরা চিকিৎসা করতে গিয়ে ভারতে গিয়ে গড়ে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন?
প্রশান্ত শর্মা: আন্তর্জাতিকভাবে যেটি বলে তিন হাজার ৮শ ডলার থেকে ৭ হাজার ২শ ডলার এটা হচ্ছে সাধারণ খরচ। এর বাইরে বেশকিছু সার্জারি আছে অনেক বেশি দাম। ধরুন একটি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে গেলে ২০ লাখ টাকা লাগতে পারে। কিংবা একটা ছোট গাইনি অপারেশন হলে এক লাখের মধ্যে হয়ে যাবে। সুতরাং, নির্ভার করে কোন ধরনের চিকিৎসা। বাংলাদেশি রোগীরা এক বছরে ভারতে মোট পাঁচশ মিলিয়ন ডলার খরচ করছে। সার্বিকভাবে গড়ে যে খরচ সেটি হলো তিন হাজার ৮শ ডলার থেকে ৭ হাজার ২শ ডলার হচ্ছে চিকিৎসা খরচ।
ভারতের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ নিয়ে আসছে, স্বাস্থ্যখাতেও প্রায় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে এই খাতে বিনিয়োগটা কতটা জোরালো হচ্ছে বলে মনে করেন?
প্রশান্ত শর্মা: বাংলাদেশি রোগী এক বছরে ভারতে পাঁচশ মিলিয়ন ডলার খরচ করছে। চিকিৎসাটা যদি বাংলাদেশে হয় তাহলে হয়তো সেই বহির্গমনটা পাঁচশ মিলিয়ন না হয়ে দেড়শ কিংবা আড়াইশ মিলিয়নে হয়ে যাবে। এটি খুব সংবেদনশীল বিষয় যদি বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা যদি বাংলাদেশে হয়। এবার আসি হচ্ছে না কেন? এখানে হাসপাতাল খারাপ আছে তা তো নয়। এখানে অনেক ভালো হাসপাতাল আছে। কিন্তু ভারতে কয়েকটি জায়গায় ক্লিনিক্যাল দক্ষতা আছে। সেই দক্ষতা যদি এখানে এনে চিকিৎসা করা হয়, তাহলে সেটা খুবই ভালো হবে।
আমার মনে হয় বিদেশি চিকিৎসকদের পরিচালনার বিষয়টি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও সরকারকে একটু ভাবতে হবে। এটা একটু বিরোধপূর্ণ, কারণ দুনিয়ার প্রত্যেক দেশেই ডাক্তার সমাজ নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা রাখেন। এটা এশিয়া ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই হয়। কিন্তু আফ্রিকাতে এই জিনিসটা নেই, অনেকগুলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশেও এ বিষয়টি নেই। আমাদের সমাজটা ভেবে নিয়ম তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য যদি এই নিয়মটি শিথিল করা হয় তাহলে অতো রোগী বাইরে যাবে না। বাইরের চিকিৎসকরা এখানে এসে বা বাইরের হাসপাতাল এখানে এসে চিকিৎসা করতে পারবে।
বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করেও অনেক সময় বিনিয়োগ করেন, একটি স্বনামধন্য হাসপাতালের এমডি হিসেবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আপনি কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখেন কি না?
প্রশান্ত শর্মা: রাজনীতি ও বিনিয়োগ সমান্তরালভাবে চলবে। একটু প্রভাব থাকে, কিন্তু ব্যবসায়ীর নিজস্ব একটা প্রবাহ থাকে। মার্কেটে ডিমান্ড সাপ্লাই অনুযায়ী বিনিয়োগ হবে। নিয়ম অনুযায়ী এফডিআই (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) আসবে। এক্ষেত্রে কোন জায়গায় কোন সরকার আসবে সেটা ব্যাপার না।
হাজার কোটি টাকার বাইরেও বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের ভাবনা আছে কি না?
প্রশান্ত শর্মা: দু’একটা গ্রুপ ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ভারতকে চিকিৎসাখাতে এফডিআই আকর্ষণ করছে আট হাজার কোটি টাকা, নতুন মার্কেট স্পেস আছে। কতটা বিনিয়োগ আসবে সেটা নির্ভর করবে বাংলাদেশের মার্কেটের ওপর এবং সরকারের নিয়ম-নীতির ওপর।
চার্নক হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীরা কী ধরনের চিকিৎসা পান? সেখানে খরচের দিকে কতটা নজর রাখা হয়?
প্রশান্ত শর্মা: আমাদের চার্নক হাসপাতাল ৩শ বেডের সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল। এখানে সব ধরনের চিকিৎসা হয়। কার্ডিয়াক, নিউরো, গ্যাস্ট্রো, ক্যানসার, ট্রান্সপ্ল্যান্টসহ সব ধরনের চিকিৎসা। আমাদের সবচেয়ে স্ট্রং ডিপার্টমেন্ট হলো ন্যাপরোলজি। আমাদের অনেকগুলো ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রোগ্রাম রান করে। যেখানে বেঙ্গল সরকার সংক্রান্ত কিংবা সংক্রান্ত নয়, যাকে আমরা অল ট্যুরিস্টেড ডোনেশন বলি, সেটা নিয়ম অনুযায়ী আমরা অনুসরণ করি। আমাদের তিনশ বেডের মধ্যে ১০৬টি আইসিইউ বেড। বিমানবন্দর থেকে নেমেই প্রথম আমাদের হাসপাতাল। আমরা সেখানে ভর্তুকি দিয়ে গেস্ট হাউজ দেই। সেখানে ৫শ টাকা রেটে প্রতিদিন গেস্ট হাউজ দেই পরিবারকে থাকার জন্য। এছাড়াও অনেক সুবিধা আছে। সেখানে একটি দারুণ পরিবেশ। যেমন সাউথের মুকুন্দপুর একটা হাসপাতাল জোন তৈরি হয়ে এসেছে, যেখানে খরচটা একটু বেশি। কিন্তু আমাদের এখানে সেই খরচটা ৭০ শতাংশের মধ্যেই হয়ে যাবে। ওখানে যদি এক লাখ টাকা লাগে মোটামুটি আমাদের এখানে ৬০-৭০ হাজারের মধ্যে হয়ে যাবে।
চার্নক হাসপাতালের বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে কি?
প্রশান্ত শর্মা: সম্ভবত ভবিষ্যতে সেটি হবে। কারণ বাংলাদেশ আমাদের জন্য আকর্ষণীয় বাজার। আপাতত আমাদের হেলথ কেয়ারের মধ্যে ভারতে অনেকগুলো স্কোপ আছে সেগুলোতে আগে করবো। তারপর যখন আরেকটু গ্রোথ নেবো সেসময় আমরা এটিও বিবেচনায় রাখবো।
রোগীদের অধিকাংশ চিকিৎসার জন্য ভারতগামী হওয়ায় সেখানে বাংলাদেশিদের যাতায়াত বেড়েছে। সার্বিক বিবেচনায় সেখানে বাংলাদেশিদের জন্য সুযোগ-সুবিধাগুলো আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন কি?
প্রশান্ত শর্মা: প্রথমত ভিসা প্রক্রিয়া আরও বেশি রোগীভিত্তিক হওয়া উচিত। এখানে অবশ্যই সরকারের কিছু প্যারামিটার আছে। কিন্তু এটা আরও যেন একটু ভালো করতে পারি। দ্বিতীয়ত লজিস্টিক অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্ট ইনফরমেশন যেমন কোন হাসপাতাল কীভাবে কাজ করছে এগুলো জানানো। এই দুটি দেশ কিন্তু নামের ওয়াস্তে দুটি দেশ আছে। কিন্তু যদি দেখেন খুব বেশি তফাত তো নেই আমরা সাবাই সেটা জানি। আমি এখানে এসেছি আমার তো মনে হচ্ছে না আমি বাইরের কোনো দেশে এসেছি। আমার মনে হচ্ছে নিজের দেশেই আছি।
বাংলাদেশিরা যখন কলকাতায় আসেন তারা মনে করে নিজের বাড়িতেই আছেন। এই সম্পর্কটা বাড়বে। কলকাতার জনসংখ্যা ১০ কোটি, আর বাংলাদেশের ১৮ কোটি। এটা তো একটা লার্জ ইকো সিস্টেম। ভবিষ্যতে তো এটা বাড়বে, কমার কোনো রাস্তা নেই। কমবে একমাত্র যখন এখানে (বাংলাদেশে) মেডিকেল স্কিলটা হাই লেভেলে চলে যাবে। কিন্তু সেটা হলেও চাহিদা তখন সেভাবে বাড়বে। মার্কেট ওপরের দিকে যাচ্ছে, এটা সব সময় গ্রোথের জায়গায়ই থাকবে।