দীর্ঘ এক মাস দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকা বইমেলার পর্দা নেমেছে আজ। শেষ দিনে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মেলায় এসেছেন দর্শনার্থীরা। বিকেল থেকে বইমেলার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রান্তে ছিল দর্শনার্থীদের ভিড়। মেলায় ছিল না তিল ধারণের ঠাঁই। মেলায় দর্শনার্থীরা ছবি তুলেছেন, বই কিনেছেন, দিনটিকে রাখতে চেয়েছেন স্মৃতির পাতায়।
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার শেষ দিনে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এদিন বেলা ১১টায় বইমেলা শুরু হয়ে রাত ৯টায় শেষ হয়। সমাপনী দিনে মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩৩৫টি। গত ২৮ দিনে বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩ হাজার ২৯৯টি।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. সরকার আমিনের দেওয়া তথ্যমতে, এবারের বইমেলায় মোট ৭৪৮ প্রতিষ্ঠানকে স্টল ও ৩৭টি প্যাভিলিয়ন অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এতে শিশুদের জন্য ১২০টি স্টল, লিটল ম্যাগাজিন ১৩০টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। মেলায় (বৃহস্পতিবার পর্যন্ত) বাংলা একাডিমি ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৯ টাকার বই বিক্রি করেছে।
এবারের বইমেলায় শিশুদের জন্য বৃহৎ জায়গা নির্ধারণ করে বিভিন্ন আয়োজন করা হয় এবং তাদের পুরস্কৃত করা হয়।
বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ কয়েকটি শ্রেণিতে লেখক-প্রকাশকদের পুরস্কার দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমির ‘কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫’ এ ভূষিত হয়েছেন কবি আল মুজাহিদী এবং ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪’ এ ভূষিত হয়েছেন- অধ্যাপক হান্স হার্ডার ও কথাশিল্পী বর্ণালী সাহা। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের পুরস্কারের অর্থ, সম্মাননাপত্র ও সম্মাননা স্মারক দেওয়া হয়।
অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি পরিচালিত চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হয়।
চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার : ২০২৪ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কথাপ্রকাশকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫ দেওয়া হয়।
মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার : ২০২৪ সালে প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঠক সমাবেশ (প্লেটো : জীবন ও দর্শন-আমিনুল ইসলাম ভুইয়া), ঐতিহ্য (ভাষাশহিদ আবুল বরকত: নেপথ্য কথা- বদরুদ্দোজা হারুন) এবং কথাপ্রকাশকে (গোরস্তানের পদ্য : স্মৃতি ও জীবনস্বপ্ন-সিরাজ সালেকীন) মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫ দেওয়া হয়।
রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার : ২০২৪ সালে গুণমান বিচারে সর্বাধিক সংখ্যক শিশুতোষ বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কাকাতুয়াকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫ দেওয়া হয়।
বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মেহাম্মদ আজম বলেন, এবার অংশ নেওয়া প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি বইমেলার সমস্যাগুলো যথাসম্ভব দূর করার। আমরা কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছি কিছু ক্ষেত্রে পারিনি। এসময় তিনি বইমেলা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, আমরা মনে করি, বাংলা একাডেমির সংস্কার প্রয়োজন। এতে লেখক, গবেষক ও গুণীজনেরা কাজ করবেন। গুণীজন হিসেবে প্রবীণদের সঙ্গে তরুণ লেখকরাও যুক্ত হবেন। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি, নবীনরা বাংলা একাডেমিতে যুক্ত হতেন না। এমনকি বর্তমান মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম আগে বাংলা একাডেমির সাধারণ সদস্যও ছিলেন না। আমরা এমনটা চাই না। আমরা আশা করব তারা যেন দ্রুত বাংলা একাডেমির সংস্কার রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ের জমা দেন।
তিনি আরও বলেন, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসেও আমরা সফলতার সঙ্গে মেলা সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি। ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে এ দেশে সবাই স্টেকহোল্ডার। কারণ এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে হাসিনাকে বিদায় করেছে। আমাদের বিরুদ্ধে সীমানার অন্য পাশ থেকে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে তা আমরা কাজের মাধ্যমে দূর করার চেষ্টা করছি। অভ্যুত্থানের পরে সাংস্কৃতিক কাজকে আরও বেগবান করতে দেশের সব কালচারাল সংগঠনগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যার অংশ হিসেবে কুষ্টিয়াকে মিউজিক্যাল টাউন, পানাম নগরকে কালচারাল টাউন করার জন্য মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ভাষা আন্দোলনের চেতনাবহ ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস। মাসব্যাপী আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা ভাষার জন্য জীবনদানকারী শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখার একটি মাধ্যম।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সচিবের রুটিন দায়িত্ব) মো. মফিদুর রহমান। বইমেলার সদস্য সচিব ড. আমিন সরকার মেলার সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।