এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে সিয়াম সাধনা করছে কোটি কোটি মুসলিম। ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ পবিত্র রমজানের রোজা। বিধিবদ্ধ ইবাদত হলেও রোজাকে ঘিরে বিশাল এই বিশ্বজুড়ে যুগে যুগে তৈরি হয়েছে নানা রকম সংস্কৃতিচর্চা। এতে ইসলামের উৎস আরবের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশেছে ভৌগোলিক অবস্থান, স্থানীয় সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসভিত্তিক রীতি-রেওয়াজ।
মূলত আরবে বেশি হওয়া সুমিষ্ট ফল খেজুর এখন বিশ্বের এমন সব দেশে খাওয়া হচ্ছে, যেখানে এর কোনো পূর্ব ইতিহাস নেই। রোজার এই সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোও। গত বছরের ডিসেম্বরে ঘোষিত জাতিসংঘের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায় রমজানের ‘ইফতার’।
বৈচিত্র্য শুধু ইফতারেই নয়, অবস্থান ও সংস্কৃতিভেদে রমজানের রোজায় বিভিন্ন দেশে কিছু আলাদা রীতিও পালন করা হয়ে থাকে।
এসব রীতির অনেক সময়ে ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। যেমন—স্বতন্ত্র নকশা এবং বিচিত্র কারুকার্যের জন্য পরিচিত লণ্ঠন মিসরীয় রমজানের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ধাতু ও রঙিন কাচে তৈরি উজ্জ্বল রঙের এই লণ্ঠন দিয়ে রোজার মাসে মিসরের রাস্তা, বাড়িঘর আলোকিত করা হয়। অন্যদিকে কামান দেগে ইফতারের সময় হওয়ার বিষয়টি জানানো হয় লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে।
মনে করা হয়, এটি বিশ্বে প্রচলিত রমজানের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোর একটি। প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এই ঐতিহ্যের উদ্ভব মিসরে। মধ্যপ্রাচ্যে এটি ‘মিদফা আল ইফতার’ নামে পরিচিত। মুসলিমপ্রধান দেশ তুরস্কে ‘দাভুল’ নামের বড় আকারের ঢোল পিটিয়ে সাহরিতে জাগিয়ে তোলা হয়। এই চর্চাও আছে অনেক দেশে।
এর সঙ্গে কোনো কোনো দেশে থাকে বিশেষ সংগীতের আয়োজন। মিসর ও জর্দানে এর গায়কদের বলা হয় মেসাহারাতি। মরক্কোতে ডাকা হয় নাফারস। এরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘গান্দোরা’, টুপি ও একজোড়া চপ্পল পরে প্রার্থনার সুরে গাইতে গাইতে ধীরগতিতে হাঁটতে থাকে।
এককালে সাহরির সময় ঘুম ভাঙাতে ঢাকায়ও শোনা যেত বাদ্য ও সংগীত। ধর্মীয় বিষয়ভিত্তিক কথা ও সুরে যারা নগরবাসীর ঘুম ভাঙাতেন, তাঁরা পরিচিত ছিলেন ‘কাসিদা কাফেলা’ নামে। সুললিত কণ্ঠে তাঁরা গাইতেন, ‘ওঠ ওঠ মমিন সাহরির সময় নাই/আমরা কাসিদাওয়ালা/যাই ডেকে যাই।’ এই গায়েন দলের গলায় পেঁচানো গামছায় ঝুলত হারমোনিয়াম, হাতে থাকত হ্যাজাক বাতি, করতাল, ডুগডুগি। রমজানকে তিন ভাগ করে কাসিদা পরিবেশন করতেন গায়েনরা।
রমজানের প্রথম ১০ দিনের কাসিদার নাম ছিল ‘আমাদি কাসিদা’। দ্বিতীয় ১০ দিনের নাম ‘ফাজায়েলি কাসিদা’ এবং শেষ ১০ দিনের কাসিদার নাম ছিল ‘রোখসাতি কাসিদা বা বিদায়ি কাসিদা’। অনুমান করা হয়, ঢাকায় কাসিদার প্রচলন সেই মোগল আমলে। বিগত কয়েক দশকে রমজানে এরই একটি ধারা পরিবেশিত হতো পুরান ঢাকার অলিগলিতে। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মাইকের প্রচলন ও আরো হাল আমলে মোবাইল ফোনের অ্যালার্ম আসার পর এই ধারাটি প্রায় বিলুপ্তির পথে।
রোজার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ইফতার। শুরুর দিকে ইফতারির আয়োজন ছিল সাদামাটা। সেকালের আরবে ইফতারির প্রধান পদ ছিল খেজুর আর উটের দুধ। ইসলামের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নানা দেশের খাদ্য ও পানীয় ইফতারির টেবিলে যুক্ত হয়েছে। দুনিয়াজুড়েই এখন ইফতারির টেবিল সাজানো হয় বিভিন্ন রকম খাবার দিয়ে। সেখানে এমন কিছু পদ থাকে যা শুধু এ মাসেই তৈরি করা হয়। বিশ্বজুড়ে বহু জায়গায় একসঙ্গে বসে ধনী-গরিব নির্বিশেষে হাজারো মানুষ ইফতার করেন। এটি সামাজিক বন্ধনও জোরদার করে।
মুুসলমানদের পবিত্রতম স্থান মক্কার কাবাঘরকে কেন্দ্র করে যে ইফতারের আয়োজন করা হয়, তার দৈর্ঘ্য হয় বারো কিলোমিটার। সেখানে একসঙ্গে লাখো রোজাদার ইফতার করেন। পরিবেশিত হয় ৫০ লাখ খেজুর আর ২০ লাখ বোতল জমজমের পানি। ইন্দোনেশিয়ার রোজাদাররা খেজুরের সঙ্গে ওন্দে ওন্দে নামে এক ধরনের বড়ি দিয়ে ইফতার করেন। এটি সেখানকার রমজানের বিশেষ খাবার। পান্ডন পাতা (যা কেওড়া পাতার মতো) পিষে খেজুরের রসের সঙ্গে মিশিয়ে ছোট ছোট ট্যাবলেট তৈরি করে তাতে আবার তাজা নারকেল ছিটিয়ে দেওয়া হয়।
মালয়েশিয়ায় ইফতারির টেবিলে থাকে আখের রস, সয়াবিন, লিম্বুক (নারকেলের দুধে রান্না করা মাংসের পদ), মোরগ-পোলাও ও বাবুলা মার্ক (চালের তৈরি ঐতিহ্যবাহী খাবার)। বিশ্বজুড়ে ইফতারিতে মুসলিমদের আয়োজনের তালিকা যেমন দীর্ঘ তেমনি বৈচিত্র্যে ভরা।