আসমানী বা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাবের সংখ্যা হলো একশত চারটি। এর মধ্যে বড় হলো চারটি। তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ও কুরআন। মুসলমানের ঈমানী দাবি হলো-এসব কিতাবের অবিকৃত অবস্থার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।
বাস্তবতা হলো একমাত্র কুরআন ছাড়া আর সব কিতাবই বিকৃত হয়ে গেছে। পরিত্র কুরআন ছাড়া অন্য কোনো কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলা নেননি। ফলে তাই হয়েছে। এখানেই কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব। কুরআন নাজিলের পর থেকে এখন পর্যন্ত কত প্রতাপশালীরা ইসলামকে, কুরআনকে মুছে ফেলতে চেয়েছে; কুরআনের আলোকে নিভিয়ে দিয়ে চেয়েছে। কিছুই করতে পারেনি। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে তারা কত সত্যকে ঘোর মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বনিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কুরআনের একটা হরফ, নোকতা, যের, যবর এর মধ্যে তারতম্য করতে পারেনি। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের কোন এক প্রান্তে কারো নিকট থাকা একটি কুরআনে মাসহাফে যে কয়টি অক্ষর ও নোকতা আছে, হেরেম শরীফের সেলফগুলোতে রাখা কুরআন শরীফের প্রত্যেকটিতে সমপরিমাণ অক্ষর ও নোকতা। একটিও কমবেশি হবে না। আমাদের কি ধারণা! ওরা কি চেষ্টা করেনি বা করছে না? তারা অহর্ণিশ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারতম্য করতে কোনো দিন পারেনি এবং পারবেও না। কারণ এটা সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন। অমুসলিম ও নাস্তিকদের জন্য মহান আল্লাহর অস্তিত্ব খুঁজে পেতে এই একটা বিষয়ই যথেষ্ট, যদি তারা বুঝতো!
ইমাম কুরতুবী (রহ.) মুত্তাসিল সনদে রাষ্ট্রনায়ক মামুনুর রশীদের দরবারের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মামুনের দরবারে মাঝে মাঝে শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হত। এতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পণ্ডিত ব্যক্তিগণের অংশগ্রহণের অনুমতি ছিল। এমনি এক আলোচনা সভায় জনৈক ইহুদি পণ্ডিত আগমন করল। আকার-আকৃতি, পোশাক ইত্যাদির দিক দিয়েও তাকে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি মনে হচ্ছিল। তাদপুরি তার আলোচনাও ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল, অলংকারপূর্ণ এবং বিজ্ঞজনসুলভ। সভা শেষে মামুন তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কি ইহুদি? সে স্বীকার করল। মামুন পরীক্ষা করার জন্য তাকে বললেন: তুমি যদি মুসলমান হয়ে যাও, তবে তোমার সাথে চমৎকার ব্যবহার করা হবে।
সে উত্তরে বলল, আমি পৈতৃক ধর্ম বিসর্জন দিতে পারি না। কথাবার্তা এখানেই শেষ হয়ে গেল। লোকটি চলে গেল। এক বছর পর সে মুসলমান হয়ে আবার দরবারে আগমন করল। আলোচনা সভায় ইসলামী ফেকাহ সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তৃতা ও যুক্তিপূর্ণ তথ্যাদি উপস্থিত করল। সভা শেষে মামুন তাকে ডেকে বললেন: আপনি কি ঐ ব্যক্তি, যে বিগত বছর এসেছিলেন? সে বলল, হ্যাঁ, আমি ঐ ব্যক্তিই বটে। মামুন জিজ্ঞেস করলেন, তখন তো আপনি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃত ছিলেন। এরপর এখন মুসলমান হওয়ার কি কারণ ঘটল?
সে বলল, এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর আমি বর্তমান কালের বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করার ইচ্ছা করি। আমি একজন হস্তলেখা বিশারদ। স্বহস্তে গ্রন্থাদি লিখে উঁচু দামে বিক্রয় করি। আমি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তাওরাতের তিনটি কপি লিপিবদ্ধ করলাম। এগুলোতে অনেক জায়গায় নিজের পক্ষ থেকে বেশ-কম করে লিখলাম। কপিগুলো নিয়ে আমি ইহুদিদের উপাসনালয়ে উপস্থিত হলাম। ইহুদিরা অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে কপিগুলো কিনে নিল। অতঃপর এমনিভাবে ইঞ্জিলের তিন কপি কম-বেশ করে লিখে খ্রিষ্টানদের উপাসনালয়ে নিয়ে গেলাম। সেখানেও খ্রিষ্টানরা খুব খাতির যত্ম করে কপিগুলো আমার কাছ থেকে কিনে নিল। এরপর কোরআনের বেলায়ও আমি তাই করলাম। এরও তিনটি কপি সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করলাম এবং নিজের পক্ষ থেকে কম-বেশ করে দিলাম। এগুলো নিয়ে যখন বিক্রয়ার্থ বের হলাম, তখন যে-ই দেখল, সে-ই প্রথমে আমার লেখা কপিটি নির্ভুল কি না, যাচাই করে দেখল। অতঃপর বেশ-কম দেখে কপিগুলো ফেরত দিয়ে দিল।
এ ঘটনা দেখে আমি শিক্ষা গ্রহণ করলাম যে, গ্রন্থটি মানব রচিত কোনো গ্রন্থ নয়। এর অসাধারণ মর্যাদা রয়েছে। এ কিতাবকে কেউ না কেউ কদরতীভাবে হুবহু সংরক্ষণ করছেন। আমার জানতে বাকি রইল না যে, আল্লাহ তা’আলা নিজেই এর সংরক্ষণ করছেন। এরপর আমি মুসলমান হয়ে গেলাম। এ ঘটনার বর্ণনাকারী কাযী ইয়াহইয়া ইবনে আকতাম।(তাফসীরে মা’রিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত/ পৃ. ৭২৬।)
এই মাহাসম্পদ আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদেরকে দিয়েছেন। অথচ আমরা তা বুঝলাম না। এই কুরআনের গুরুত্ব অনুধাবন করলাম না। পৃথিবীর এতো বইপুস্তক পড়লাম, গবেষণা করলাম। মহাসত্য ও মূল্যবান কুরআন পড়েও দেখলাম না, বুঝতে চেষ্টা করলাম না, সে অনুযায়ী জীবন গড়তে সচেষ্ট হলাম না!
দ্বন্দ্বমুখর এ পৃথিবীতে মানুষকে সঠিক পথের দিশা পাওয়ার জন্য এ পবিত্র কুরআন সর্বোত্তম পথনির্দেশক। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা চমৎকার ভাষায় বলেছেন, অর্থাৎ-‘রমজান মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, মানুষের জন্য সৎপথের প্রদর্শনকারী, সরল-সঠিক পথকে স্পষ্টকারী এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসাবে। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, ‘এই কুরআন (মানব জাতিকে) সর্বোত্তম পথ প্রদর্শন করে। সৎ কর্মপরায়ন মুমিনদেরকে এই সু-সংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহা-পুরুস্কার’। (সূরা ইসরা: ০৯)
আল্লাহ তা’আলা বলেন, অর্থ: যে আমার এই (কুরআনের) প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করবে সে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না।
কুরআন সম্পর্কে এক নাতিদীর্ঘ হাদীসে বর্ণানা এসেছে এভাবে: হযরত আলী (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) একদা আমাদের সামনে নাতিদীর্ঘ এক বক্তৃতায় বললেন, তোমরা কুরআনকে আকড়ে ধর। কেননা কুরআন তোমাদের মুক্তির জন্য এমন সুপারিশ করবে যা গ্রহণ করা হবে। …. যে তাকে ইমাম বানাবে কুরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। যে তাকে ভ্রুক্ষেপ করবে না সে তাকে জাহান্নামে পৌঁছে দিবে। ….(কানজুল উম্মাল)
আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, আমি তোমাদের নিকট দুটি জিনিস রেখে গেলাম। তোমরা যাদি সে দুটোকে আকড়ে ধরতে পারো তবে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। তাহলো: আল্লাহর কুরআন ও আমার সুন্নাহ। (মুয়াত্তা:৩৩৩৮)
মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারীম হলো এই উম্মতের গর্বের বিষয়। এই উম্মতের সম্মানের মানদণ্ড ও সাফল্যের চাবিকাঠি। কুরআনের সাথে আপনি যেভাবেই সম্পর্ক করুন না কেন তাতেই আপনি লাভবান হবেন। সম্মানিত হবেন এবং সঠিক পথের দিশা পাবেন। যেমন:
১. কুরআন পড়লেই নেকি। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে: হরযত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ (অক্ষর) পাঠ করবে, সে একটি নেকী প্রাপ্ত হবে। আর এই এক নেকীকে দশগুণ করে দেওয়া হবে। আমি একথা বলছি না যে, ‘আলিম লাম মীম’ একটি হরফ। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, ‘লাম’ একটি হরফ, ‘মীম’ একটি হরফ। (তিরমিযি: হাদীস নং-২৯১০)
২. কুরআন তিলাওয়াতকারী পরকালে সম্মানিত ফেরেশতাদের শ্রেণিভুক্ত হবেন: হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, দক্ষতার সাথে কুরআন তিলাওয়াতকারী কিয়ামতে বিশিষ্ট সম্মানিত ফেরেস্তাদের সমমর্যাদা প্রাপ্ত হবেন। অপরদিকে যিনি তার মুখের জড়তার কারণে কষ্ট করে করে কুরআন পড়বেন তিনি দুটি পুরুস্কার প্রাপ্ত হবেন। (মুসলিম: ২৪৪)
৩.কুরআন বিহীন অন্তর শূন্য ঘরের মতো। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অর্থ: ‘নিশ্চয়ই যার অন্তরের মধ্যে কুরআনের সামান্যতম কোন অংশ নেই সে বিরান বাড়ির মত’। (তিরমিযি: ২৯১৩) অর্থাৎ-তার অন্তরটা মৃত্যু। তাকে প্রকৃত অর্থে জীবিত মানুষ বলা যায় না। সে জড় ও শক্তিহীন।
কাজেই সফলতা পেতে হলে কুরআন নির্দেশিত পথ অবলম্বন করতেই হবে। পবিত্র মাহে রমজানে এই ‘কুরআনুল কারীম’কে আল্লাহ তা’আলা ‘লউহে মাহফুয’ থেকে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ করেছেন। ফলে কুরআনের সর্বাধিক চর্চা হওয়ার কথা এই রমজানে। অনেকে করছেনও।
কুরআনের প্রথম দাবি হলো-বিশুদ্ধ তিলাওয়াত বা বিশুদ্ধভাবে পড়তে জানা। নামাজের জন্য অন্যতম শর্ত হলো নামাজে অন্তত যতটুকু কুরআন পড়া হবে তা যেন বিশুদ্ধ হয়। শুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা করাটাও অনেক সহজ। অতএব, আসুন কুরআন নাজিলের মাসে কুরআনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি। বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতে করি। কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী নিজের জীবনটা পরিচালনার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। তাহলেই আমরা সঠিক পথের দিশা পাবো, উভয় জাহানে সফলতা মিলবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে তৌফিক দিন, আমীন।