পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। কোলকাতা থেকে কম দূরত্ব হওয়ায় এই স্থলবন্দরে কর্মচঞ্চলতা বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েক গুণ। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এই স্থলবন্দরকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে সরকারের রাজস্ব আয় আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, পদ্মা সেতুর কারণে সাতক্ষীরার আম ও চিংড়িসহ বিভিন্ন পচনশীল পণ্য পরিবহনে সুবিধা এসেছে ব্যাপক। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে ফেরির ভোগান্তি কমে আসায় নিশ্চিন্ত মনে পচনশীল পণ্য সারা দেশে পৌঁছে দিতে পারছেন ব্যবসায়ীরা।
‘সাতক্ষীরার আকর্ষণ-সড়কপথে সুন্দরবন’ এ স্লোগানটি আরও সহজ হয়েছে পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমে। এখন দেশের যেকোনো স্থান থেকে পর্যটকরা সড়ক পথেই সুন্দরবন দেখতে আসার সুযোগ পাচ্ছেন। যার ফলে সাতক্ষীরার সামগ্রিক অর্থনীনিতে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
ভোমরা স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে এই স্থলবন্দরে প্রতি কর্মদিবসে প্রায় ১০০টির বেশি বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ট্রাক ভারত থেকে প্রবেশ করছে। ২০২২ সালের মে মাসে ভোমরা স্থলবন্দর থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের মে মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা।
খুব সহজেই সাতক্ষীরার আম দেশের বিভিন্ন স্থানের বাজারে নিতে পারছেন ব্যবসায়ীরা
আরও জানা যায়, কোলকাতা থেকে ভোমরা স্থলবন্দরের দূরত্ব মাত্র ৬০ কিলোমিটার। দূরত্ব বিবেচনায় বন্দরের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও আরিচা ফেরিঘাটে যানজটের কারণে এই বন্দর ব্যবহারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতেন ব্যবসায়ীরা। তবে ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা থেকে সাতক্ষীরার দূরত্ব কমেছে ৬২ কিলোমিটার। ফলে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেড়েছে স্থলবন্দরটিতে।
ব্যবসায়ীদের অভিমত,পদ্মা সেতুর ফলে পাল্টে গেছে ভোমরা স্থলবন্দরের দৃশ্যপট।
সাতক্ষীরার সুলতানপুর বড় বাজার কাচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম বাবু বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে আমরা যখন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় আম পাঠাতাম, তখন অনেক সময় আম পচে যেত। পচা আম ফেলে দিয়ে আসতে হতো আমাদের। এখন আমরা মাত্র ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকায় আম নিয়ে যেতে পারছি।’
সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খান বলেন, ‘কোলকাতা থেকে ভোমরার দূরত্ব অনেক কম। পদ্মা ব্রিজ হয়ে খুবই উপকার হয়েছে ব্যবসায়ীদের। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা মালামাল রাজধানীসহ দেশের যে কোনো স্থানে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোমরা স্থলবন্দরে কাস্টমস হাউস না থাকায় ৭২টি পণ্যের অনুমোদন থাকলেও ২২-২৫টি পণ্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীরা পদ্মা সেতুর পুরো সুফল পাচ্ছেন না, তেমনি সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত হচ্ছে সুন্দরবন
সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক শেখ এজাজ আহমেদ স্বপন বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার পর সাতক্ষীরার অর্থনীতি আমূল বদলে গেছে। মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হয়েছে। চাইলে তারা দিনের কাজ শেষ করে দেশের যে কোনো স্থানে ফিরতে পারছেন। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। মাছ অক্সিজেনের মাধ্যমে ঢাকাসহ রাজধানীর আশপাশের জেলায় যাচ্ছে খুব সহজেই। আমদানি করা পণ্য বিশেষ করে পচনশীল পেঁয়াজ, আদাসহ কাঁচামাল ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে।’
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, ‘দেশের দক্ষিণের এই জেলায় মাছের মোট উৎপাদন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৩ টন। পদ্মা সেতুর কারণে সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় এখানকার মাছ দিনের মধ্যে দেশের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া সহজ হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে অনেক লাভবান হচ্ছেন।’
পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) একেএম ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার পর সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অঞ্চলে পর্যটক বেড়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে। সড়ক পথে সুন্দরবন দেখার সবচেয়ে সহজ উপায় সাতক্ষীরা। যে কারণে মানুষ পদ্মাসেতু দিয়ে সরাসরি সুন্দরবন আসতে পারছেন। এতে সরকারের রাজস্বও বৃদ্ধি পেয়েছে।’
সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু বলেন, ‘পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চলের আশা ও উন্নয়নের প্রতীক। এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদল হয়েছে। ভোমরা স্থলবন্দরের রাজস্ব ও রপ্তানি বেড়েছে। সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরেছে। তেলের দাম বাড়লেও সময় ভোগান্তি কমায় তা পুষিয়ে নিতে পারছেন ব্যবসায়ীরা।’