শান্তির দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ডের সুখ্যাতি বিশ্বজোড়া। সচরাচর এই দেশটিকে নিয়ে কোনো অশান্তি গণমাধ্যমে চোখে পড়ে না। দেশটি সবুজে ঘেরা। সেখানে হানাহানির খবর কমই চোখে পড়ে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাও কম।
এই শান্তিপূর্ণ দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জেসিন্ডা আরডার্নের সুখ্যাতিও বিশ্বজোড়া। দেশের মতো তিনি নিজেও পরিশুদ্ধ ইমেজ তৈরি করেছেন। ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে নিউজিল্যান্ডের ৪০তম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ১৮৫৬ সালের পর তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী নারী সরকারপ্রধান। দেশের বিভিন্ন কঠিন সময়ে দেশের মানুষের পাশে থেকেছেন এবং নিজে অগ্রভাগে থেকে সেই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এ কারণে তার সময় ছিল নিউজিল্যান্ডের জন্য অন্যতম ভালো সময়।
যদিও এ সময়ে বিশ্বে নানা সংকট এসেছে কিন্তু তার মোকাবিলা তিনি করেছেন ভালোভাবেই। মানবিক গুণাবলী ভালোভাবেই রাজনীতিতে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন জেসিন্ডা। তার নেতৃত্ব, জণকল্যাণমূলক সিদ্ধান্ত এবং মানবিকতা তাকে নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বেও জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তা না হলে পদ থেকে সরে যাওয়ায় ঘোষণার পর মানুষের মনে বিস্ময়ের জন্ম হতো না। অনেকে এ জন্য আফসোসও করছেন। যদিও সব ক্ষেত্রেই কাউকে সরে গিয়ে কাউকে জায়গা করে দিতে হয় কিন্তু তার একটি সময় রয়েছে। জেসিন্ডা আরডার্নের সেই সময় এখনও হয়নি বলেও অনেকে মনে করেন।
কাজের জন্য, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের জন্য, পারস্পরিক সহাবস্থানের জন্য তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। সম্প্রতি তিনি আলোচনায় এসেছেন আচমকা তার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে। কারণ তিনি এখনো দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। তার বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগও নেই। তারপরও তিনি ক্ষমতার শীর্ষ থেকে সরে দাঁড়ালেন এবং আবারও প্রমাণ করলেন রাজনীতিবিদ হিসেবে কীভাবে সব সামলাতে হয় এবং কখোন সরে যেতে হয়।
আমেরিকায় নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর সহিংস বিক্ষোভ হয়েছে। ক্যাপিটাল হিল আক্রমণের শিকার হয়েছে। আবার ব্রাজিলে সম্প্রতি নির্বাচনের পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বিশ্বে যখন এই অবস্থা এবং রাজনীতিবিদদের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কমতে শুরু করেছে তখন রাজনৈতিক সময়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে জেসিন্ডার ওপর মানুষের আস্থা জন্মেছে। তার এই সরে দাঁড়ানোর পেছনে কোনো শক্ত কারণ জানা যায়নি। তিনি নিজেও বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। এক মন্তব্যে তিনি বলেন, স্বীকার করতেই হবে দীর্ঘদিন পর গত রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছি। দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়ে নিশ্চিতভাবে খারাপ লাগছে। কিন্তু তারপরও অনেকখানি স্বস্তি কাজ করছে। সবার কাছ থেকে যেভাবে কৃতজ্ঞতার বার্তা পেয়েছি, তাতে সত্যিই আমি মুগ্ধ।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আগামী ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ জেসিন্ডা আরডার্নের শেষ কর্মদিবস হবে। তার পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তিনি পরিশ্রান্ত এবং নেতৃত্ব দেবার মতো যথেষ্ট শক্তি নেই। কিন্তু সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তিনি এমন সময় কেন পদত্যাগ করলেন? সচরাচর দেখা যায় রাজনীতিতে বয়সের কারণে কেউ সরে দাঁড়ান বা নির্বাচনে হেরে গেলে বা শারীরিক কারণে। কখনো রাজনীতির ঘাত-পাল্টাঘাতে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়। তবে বয়স কোনো বাধা নয়। কিন্তু রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার সঠিক সময় কখন তা জেসিন্ডা আরডার্ন আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। একদিকে তার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা এবং অন্যদিকে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সাথে সাথে বিশ^ব্যাপী সুনাম অর্জন করা। সব যখন তিনি পেয়েছেন তখন তিনি সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আচমকা এসেছে।
একটা সমালোচনা আছে যে, নিউজিল্যান্ডে আগামী ১৪ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। জনমত জরিপ বলছে, তার দল লেবার পার্টির পুনরায় জয়লাভের সম্ভাবনা কম। কিন্তু এটাই কি সর্বশেষ কারণ হতে পারে? তার মতো একজন সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এভাবে সরে দাঁড়াবেন? একজন যোদ্ধা কখনোই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যায় না। হেরে যাওয়ার ভয়ে কেউ রাজনীতি করেন না। কিন্তু একজন স্বচ্ছ রাজনীতিক হিসেবে তিনি যে উদাহরণ তৈরি করেছেন সেটা মানুষ মনে রাখবে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি নানা বৈশ্বিক এবং দেশীয় প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। নিউজিল্যান্ডের সেই ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তার ভূমিকা বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করে। হামলার পর তিনি সেখানে ছুটে যান এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন, সহানুভূতি দেখান। তিনি সেসময় বিশ্বকে একটি বার্তা দেন। সেটা হলো সম্প্রীতির বার্তা। তিনি তার দেশের বন্দুক আইনের সংস্কার করেন। তার এই বার্তা বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়ায়। এরপর আগ্নেয়গিরির উদগিরণ এবং তারপরেই বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়ঙ্কর ছোবলে বিপর্যস্ত প্রাণ এবং অর্থনীতি। ততদিনে তিনি বিশ্ব রাজনীতির প্রগতিশীলতার প্রতীকে পরিণত হন। তার দৃঢ়তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়। তিনি এসবের মধ্যেই ২০২০ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন।
তিনি এক অসাধারণ সত্য উপস্থাপন করেছেন শেষ বেলায়। তিনি বলেছেন, তিনি একজন মানুষ। রাজনীতিকরাও মানুষ। তারা যত দিন পারেন, তত দিন সবটুকু দিয়েই কাজ করবেন। তারপর সময় হলে সরে দাঁড়াবেন। এখন তার সেই সময় হয়েছে। তিনি এও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কঠিন হওয়ার কারণে তিনি পদত্যাগ করছেন না। অন্যরা তার চেয়ে আরও ভালো কাজ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন তিনি। অর্থাৎ তিনি অন্যদের সুযোগ করে দিয়েছেন যিনি দেশকে আরও ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারেন।
সত্যি আমরা যা বাইরে থেকে ভাবি সেটা তো নয়। রাজনীতিবিদরাও মানুষ। তাদেরও পরিবার আছে। সময় দিতে হয়। যদি কাজ থেকে একটু বিশ্রাম নেওয়া যায় তো ক্ষতি নেই। ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি মা হয়েছেন। তিনি করোনাকালীন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। করোনার কঠিন সময়ে তিনি দেশবাসীকে সাথে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন এবং সাফল্য পেয়েছেন। এখন তার সরে যাওয়ার ঘোষণায় সেখানে নতুন কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আসবেন। জানা গেছে, তার স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন ৪৪ বছর বয়সী ক্রিস হিপকিনস। তিনি দেশটির পুলিশ, শিক্ষা ও জনসেবা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও এর জন্য তাকে লেবার পার্টির আনুষ্ঠানিক সমর্থন পেতে হবে। তারপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। কিন্তু জেসিন্ডা আরডার্ন বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে আস্থা ও সফলাতার অনন্য প্রতীক হয়ে থাকবেন। একই সঙ্গে জনপ্রিয় থাকা অবস্থায় তার সরে দাঁড়ানো সে দেশের ইতিহাসও নিশ্চয়ই মনে রাখবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট