সময়টা ১৭৪২ সাল। পলাশী যুদ্ধের কিছু আগে। ভারতের উত্তর প্রদেশে সিকান্দ্রারার কাছে বালুকুন্ডা গ্রাম। মহান বাদশাহ আকবর শুয়ে আছে এই সিকান্দ্রারাতে। সময়টা মোঘল আমলের শেষের দিকের গল্প।
একটা বাচ্চা ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদছে। বিধবা মা বাচ্চাটার পাশে নির্বিকার বসে আছে এবং কোন খাবার যোগাড় করতে পারছে না, এতই অভাব। ছোট মেয়ের আর কতটুকুই বা খাবার লাগে, তাও তার দেবার সামর্থ্য নেই। মেয়েটির নাম মুন্নি। সেই সময় গ্রামে গ্রামে প্রায় নর্তকীদের দল আসতো ঘুরে ঘুরে বাচ্চা সংগ্রহ করতে। কোন উপায় না দেখে বিধবা মা বিশুর নর্তকী দলের কাছে তার মেয়েটাকে বিক্রিই করে দিল। অন্ততঃ খেয়ে পড়ে তো বাচুক বাচ্চাটি। আহা!
‘বুব্বু’নামে বিশুর নিজেরও এক কন্যা সন্তান ছিল। বিশু ও তার দল দিল্লীতে চলে গেল, সেখানে তারা পাঁচ বছর থাকলো। ছোট্ট মেয়ে মুন্নি বুব্বুর সাথে খেলতে খেলতে ও বিশুর কাছে নাচ শিখতে শিখতে ধীরে ধীরে বড় দক্ষ নৃত্য শিল্পী হয়ে উঠল। এই দক্ষ,পারদর্শী নৃত্য দলের বিভিন্ন রাজদরবার থেকেও ডাক আসতো। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে তাদের দল একেবারে আকাশে উঠে গেল, দলের ও মুন্নির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
যদিও তিনি কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান নয়, তারপরেও তার সৌন্দর্য, নৃত্যের দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা সহ সমস্ত গুণ দিয়ে তিনি প্রথমে একজন বিখ্যাত নর্তকী এবং পরবর্তীতে বাংলার নবাবের এক নামজাদা বেগম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। আজও মুন্নি বেগম ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাই আজকে আমরা জানবো কীভাবে মুন্নি একজন নর্তকী থেকে বেগম হলেন? কীভাবে নবাবী শাসনে মোঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের মতো রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছিলেন?
এবং কীভাবে তিনি তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত চক মসজিদ ও আরো অনেক কিছু।
ঘটনার শুরু, বাংলার মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের বিয়েকে কেন্দ্র করে। ঘষেটি বেগমের পালক পুত্র ইকরামুদ্দৌল্লা এবং সিরাজ উদ-দৌল্লার বিয়ে, চারদিকে হৈ চৈ আর আনন্দ। ঘসেটি বেগম ছিলেন নবাব আলীবর্দী খানের বড় মেয়ে। নবারের নাতির বিয়ে উপলক্ষ্যে ১০ হাজার টাকা দিয়ে শাহজাহানবাদ থেকে বিশুর নর্তকী দল আনা হল মুর্শিদাবাদে।
বিশুর এই দলের অন্যতম নর্তকী মুন্নির নাচ সবাইকে মোহাবিষ্ঠ করে। বিয়ের কাজ শেষ হয়ে গেলেও নবাবের বিশেষ কাজে এই দল আরো কিছুদিন রাজপ্রাসাদেই থেকে যায়। আমোদ প্রমোদ শেষে, একসময় নবাব যখন তাদের বিদায় করে দেন, তখন তারা নতুন কোন কাজ পাবার আশায় কিছুদিন মুর্শিদাবাদেই বাস করতে থাকে।
মুন্নির রুপ সৌন্দর্য আলীবর্দি খানের প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের নজর কাড়ে এবং তিনি মোহাবিষ্ট হয়ে মাসিক ৫০০ টাকা বেতনে তাকে রাজনর্তকী হিসেবে রেখে দিলেন তার হারেমে।
কিছুদিনের মধ্যেই হারেমে তার বুদ্ধিমত্তা ও সুনাম দুইই ছড়িয়ে পড়ে, আর সেও হারেমের প্রধান পদটি পেয়ে যান এবং মীর জাফর ক্রমান্বয়ে তাকে বিয়েও করে বসে। যদিও তার আগের একটি স্ত্রী ছিল। প্রথম স্ত্রী শাহ খানমের থেকেও তিনি মীর জাফরের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার দিক থেকে তারই প্রাধান্য দেখা যায়। পরবর্তীতে মীরজাফর বুব্বু বাঈকেও বিয়ে করেছিলেন। ১৭৬৫ সাল, মীরজাফর মৃত্যুবরণ করেন এবং তার বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে যান মুন্নি বেগম।
স্বামীর মৃত্যুর পরে ক্ষমতা ধরে রাখতে তিনি বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বড় বড় ব্যাক্তিদের সাথে গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক।
বিশেষ করে, রবার্ট ক্লাইভের সাথে মুন্নি বেগমের ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। জানা যায়, লর্ড ক্লাইভ মুন্নি বেগমকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি নিজে এবং কোম্পানির অন্যান্য কর্মকর্তারা মুন্নিকে ‘তাদের মাতা’ হিসেবে সম্মান দেবেন। সেই থেকে মুন্নিকে ‘মাদার অব কোম্পানী’ বা ‘কোম্পানীর মাতা’ বলা হয়। বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মুন্নি বেগমকে খুব সন্মানের চোখে দেখতেন। তারা মুন্নি বেগমকে মাসিক ১২০০০ টাকা ও বুব্বু বেগমকে ৮০০০ টাকা বৃত্তি দিতো।
আরো জানা যায়, মুন্নি বেগম ক্লাইভকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন ১৫ বছর বয়সী তার ছেলে নাজমুদ্দৌলাকে মসনদে বসানোর বিনিময়ে। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় নাজমুদ্দৌলা মারা যান এবং তারপর তার ভাই ১৬ বছর বয়সী সৈয়ফুদ্দুলা মসনদে বসেন। ছেলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার জন্যে মুন্নি বেগমই অভিভাবক হয়ে সিংহাসনের কাজ চালান। মুন্নি বেগম অন্দরমহলের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি প্রাসাদের যাবতীয় ব্যয় খরচের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাসাদের কর্মচারীদের বেতন, জেনানা মহলের ভরণ-পোষণ, অতিথি আপ্যায়ন এবং ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের জন্য প্রতি মাসে প্রায় তেইশ হাজার রূপি খরচ করতেন। কিন্তু এই ছেলেরও বসন্ত রোগে মৃত্যু হলে মসনদের উত্তরাধিকার পায় বুব্বু বেগমের ছেলে, আর বুব্বু বেগম চলে আসেন অভিভাবক পদে।
বুব্বু বেগমের প্রভাব বেড়ে যায়। মুন্নি বেগম কিন্তু নিজের এ অবস্থা মেনে নেননি এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের সহায়তায় তিনি পুনরায় হারেমের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান। এসময় নন্দকুমারের ছেলে গুরুদাসকে তার সহকারি নিয়োগ করা হয়।
মুন্নি বেগম অনেক সমাজসেবা করতেন। তাঁর দান ও উদারতা রানী ভবানীর সাথে তুলনীয়। তিনি এতিম মেয়ে এবং বিধবাদেরকে সাহায্য করতেন। কোন বন্ধুর সাথে তিনি কখনোই প্রতারণা করেননি।
১৭৬৭ সালে মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত চক মসজিদটি মুন্নি বেগম নির্মাণ করেন, যেকারণে এটি ‘বেগম মসজিদ’নামে পরিচিত। নাটোরের জমিদার রাণী ভবানীর সাথে মুন্নি বেগমের ভালো সম্পর্ক ছিল। রাণী ভবানী তাকে ত্রিশ জন বেহারাসহ একটি পালকি উপহার দেন। এমনকি রাণী এ সকল বেহারার ভরণ-পোষণের জন্য জমিও দিয়েছিলেন।
১৮১৩ সালে ৯০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর জন্য ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ-এ ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং ৯০ টি তোপ ধ্বনি চালানো হয়। বাংলার বেগমের এ এক বিরল সন্মান। তাকে তার স্বামী মীর জাফরের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে কবর দেয়া হয়।
সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া সামান্য একজন নারী মুন্নি নিজ দক্ষতা ও বুদ্ধিতে বাংলার বিস্বাসঘাতক নবাব মীর জাফরের দ্বিতীয় স্ত্রী হয়েছিলেন এবং আপন ক্ষমতায় বৃটিশদের সাথে সম্পর্ক রেখে নবাবী শাসনকে দৃঢ় হাতে টিকিয়ে রেখেছিলেন। যেকারণে বাংলার ইতিহাসে এই অসাধারণ মুন্নি বেগম সম্পর্ক কিছু লেখা যেতেই পারে।
তথ্যসূত্রঃ
‘বাঙ্গালার বেগম’, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্ধ্যোপাধ্যায়, সোম পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৭।
বাংলাপিডিয়া ও ইন্টারনেট।
রিফাত আহমেদ,
চেয়ারপার্সন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।
কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন।