সুরমা নদী থেকে উৎপত্তি হওয়া ‘ভটের খাল’ নদীর পাড় ভাঙনের কারণে হুমকিতে পড়েছেন সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার তিন শতাধিক পরিবার। ভাঙনের কবলে পড়ে অনেক বাসিন্দা সরিয়ে নিয়েছেন ঘরবাড়িও।
নদীর পশ্চিম পাড়ে উপজেলার সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগাঁও, পূর্ব চাঁনপুর ও বেরাজপুরের বাসিন্দারা ভাঙনের মুখে রয়েছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, ১০ বছর ধরে নদী তীরবর্তী গ্রামের কৃষিজমি, ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। অনেকেই নিজের ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যের বাড়িতে থাকছেন। গত বছর নদীর তীরে কিছু জিওব্যাগ দেওয়া হয়েছিল। তবে তুলনামূলকভাবে ‘কম’ জিওব্যাগ দেওয়ার কারণে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়নি। চলতি বছর আরও কিছু জিওব্যাগ দেওয়া হলেও ভাঙন বন্ধ হয়নি। ১৫ দিন আগে ফের ভাঙন দেখা দিয়েছে; যার কারণে কয়েক পরিবারের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যের বাড়িতে উঠেছেন।
বর্তমানে নদী তীরের ৪০০ থেকে ৫০০ মিটার জায়গায় ভাঙন হচ্ছে বলে জানা গেছে। ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে নদীর তীরবর্তী তিনটি গ্রামের বাসিন্দারা তাদের ঘরবাড়ি-ফসলি জমি হারিয়ে একেবারে শেষ হয়ে যাবে, আশঙ্কা স্থানীয়দের।
সৈদেরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হোসাইন আহমদ রনি বলেন, নদী ভাঙনের কারণে এলাকার অন্তত তিন শতাধিক পরিবারের দেড় হাজার মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্তমানে নদী তীরবর্তী পাঁচ থেকে আটটি ঘর বিলীনের পথে রয়েছে। নদী ভাঙন বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার; তা না হলে অনেকে নিজেদের বসতভিটা ও কৃষিজমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে।’
দোয়ারাবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. শমশের আলী বলেন, নদীটির আট কিলোমিটার এলাকা খনন ও ভাঙন রোধে নদীপাড়ের ছয় কিলোমিটার এলাকায় পাকা ব্লক স্থাপনে একটি ডিপিপি রেডি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে দ্রুতই কাজ শুরু হবে।
ইতিহাস বলছে, ভটের খাল নদীর উৎপত্তিস্থল সুরমা নদী। গোবিন্দগঞ্জের উত্তর প্রান্ত দিয়ে বহে যাওয়া সুরমা নদী হতে পূর্বদিকে এই ভটের খাল নদী প্রবাহমান রয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ বড়চাল হয়ে দোলার বাজার ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে মঈনপুর বাজারের সীমানা দিয়ে দুদিকে নদী বয়ে গেছে।
পশ্চিম দিকে রাউলী খাসগাঁও এবং পূর্ব-দক্ষিণ দিকে চেলারচর আনুজানী পর্যন্ত নদীর সীমানা। প্রায় ১৫ কলোমিটার লম্বা এ নদী। বর্ষা মৌসুমে জেলেরা নদীতে মাছ ধরে। এ সময় নদী কানায় কানায় পূর্ণ থাকে।
সরকারি নথিপত্রে একে ‘বটের খাল’ নদী বলা হলেও স্থানীয়দের কাছে এটি ‘ভটের খাল’ নদী হিসেবেই পরিচিত।
সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক এবং নদীপাড়ের দিঘলী গ্রামের বাসিন্দা তাপস দাশ পুরকায়স্থের দাবি, এটি ভটের খাল। দিঘলী গ্রামের ভট বংশের লোকেরা এটি খনন করেছিলেন বলেই এই নাম। আর স্থানীয়ভাবে লোকজন একে ‘ভটের খাল’ই বলেন।
নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে নদীর পশ্চিমপাড় ভাঙছে, আর পূর্বপাড় গড়ছে। এর কারণ হিসেবে বাসিন্দারা দাবি করেন, বর্ষাকালে নদীতে যখন পানি থাকে, তখন পানির স্রোত পশ্চিমপাড়ে এসে ধাক্কা দেয়। পূর্বপাড়ে একটি বাঁক (মোড়) থাকার কারণে পানি সরাসরি পশ্চিমপাড়ে এসে ধাক্কা খায়। এর কারণে শুকনা মৌসুমে পশ্চিমপাড়ে ভাঙন হয়।
নদী তীরবর্তী পূর্ব চাঁনপুর গ্রামের বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা রবি লাল দত্ত বলেন, ভটের খাল নদীটির ভাঙন চলমান থাকলে সিলেট-ছাতক রাস্তাটি ঠিকবে না। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কেও ভাঙন দেখা দেবে। তাই দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। গ্রামের অনেকের ফসলি জমি, ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। গত বছর কিছু জিওব্যাগ ফেলা হয়েছিল; আর এ বছরের এক মাস আগে আরও কিছু ব্যাগ নদীর তীরে ফেলা হয়। তবে ভাঙন বন্ধ হয়নি; ভাঙন আরও বেড়েছে।
রবি লাল বলেন, আমার নিজের জমিও ভাঙনের মুখে পড়েছে। এভাবে ভাঙন চলতে থাকলে আমাদের বাড়ি-ঘর নদীতে বিলীন হবে। পাকা ব্লক আর জিওব্যাগ দিয়ে ভালো করে নদীর তীর বাঁধতে হবে। তা না হলে তিনটি গ্রাম টিকবে না।
পূর্ব চাঁনপুর গ্রামের যুবক অভিজিৎ দত্ত টিপু বলেন, পাড়ে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি, রাস্তা, গাছ ও ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে। নদী ভাঙন দেখে অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এর আগে নদীতে ১৫টি পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। আর আট থেকে ১০টি পরিবার ভাঙন দেখে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন। অন্যের বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকছেন।
ভটের খাল নদী তীরবর্তী বাসিন্দা যুবক রিপন আহমদ বলেন, গত এক মাস আগেও তাদের বসতভিটার সামনে রাস্তাঘাট, গাছপালাও ছিল। তারপর ১৫ দিন আগে ভাঙন দেখা দিয়ে প্রথমে গাছ ও রাস্তা নদীতে বিলীন হয়। পরে বাধ্য হয়ে নিজেদের বসতভিটা থেকে ঘরটি সরিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে পরিবারের সাতজন সদস্য নিয়ে অন্যের বাড়িতে থাকছেন।
রিপন আহমদের বাড়ির পাশের বাসিন্দা সৈদেরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য পূর্ণিমা রানী দে। নিজের বসতভিটায় নদী ভাঙন দেখিয়ে তিনি বলেন, “১০ বছর ধরে ভাঙন বেড়েছে। আমরা ভাঙনের মধ্যে খুব খারাপ অবস্থায় আছি। এদিকে একজন গভবতী মা যেতে পারেন না; ছাত্ররা স্কুলে যেতে পারে না। আর ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ সবকিছু ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে নদীটি। এই পাড়ার ৬০ থেকে ৮০টি ঘর ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। নদী ভাঙন রোধে আমরা দ্রুত সাহায্য চাই। আমাদের এলাকাবাসীর অবস্থা খুবই খারাপ।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডি ছাতক উপজেলা প্রকৌশলী সাব্বীর আহমেদ বলেন, নদী ভাঙনের কারণে আমাদের ২০ মিটার রাস্তা ধসে পড়ে গেছে নদীতে। তবে ওই সড়কটি সংস্কারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সিলেট বিভাগীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ভটের খাল নদী ভাঙন রোধে পাকা ব্লক স্থাপনের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি। উন্নয়ন প্রকল্প ডিপিপি অুনমোদন হলে দ্রুত কাজ শুরু হবে।