দেশের এনজিওগুলো এক্টিভিস্ট না হয়ে উন্নয়ন অংশীদার পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। করোনাকালে তাদের স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসার ভূমিকাও সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন দেশের স্বনামধন্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। শনিবার (১০ অক্টোবর) রাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত এক ওয়েবিনারে তারা এই মত জানান। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠানে গতকালের আলোচনার মূল বিষয় ছিল- বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা।
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. তৌফিক জোয়ার্দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে আলোচক অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট মহামারীবিদ অধ্যাপক ড. দীপক মিত্র, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ড. রাশেদ শাহ, বিশিষ্ট সংক্রামক ব্যাধি মহামারীবিদ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজা রিফাত।
বিশেষজ্ঞ, তা তিনি সরকারের ভেতর-বাহির যেখানেই থাকুক না কেন সবার স্বার্থে তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক বিষয় উল্লেখ করে ড. দীপক বলেন, অতীতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এনজিওগুলোর সাথে সরকার নিবিড়ভাবে কাজ করলেও করোনাকালে এর বিপরীত ব্যাপারটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও মহামারীকালে কে সরকারে আর কে বাইরে আছে তা নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশে সবেচেয়ে সফল সম্প্রসারিত টিকা দান কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় পোলিও নির্মূল কর্মসূচী বাস্তবায়নে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে কাজ করেছিল বলে উল্লেখ করেন ড. রাশেদ। তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকার এগিয়ে এসেছিল বেসরকারি খাতের কাছে। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে করোনা নিয়ে সারা বিশ্ব সতর্ক হওয়া শুরু করলেও ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ। ৮ই মার্চের আগ পর্যন্ত এ নিয়ে কোন উদ্যোগই ছিল না। এক্ষত্রে বেসরকারি খাতও দায় এড়াতে পারে না। সরকারও অবশ্য তাদের সম্পৃক্ত করতে এগিয়ে আসে নি। পূর্বেকার মতো কোন ভূমিকা সরকারের ছিল না।
ড. মাহফুজা বলেন, অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় সরকারগুলো বেসরকারি খাতের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে বলেই বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতের অনেক নির্ধারকে ভালো উন্নতি করেছে। সেদিক বিবেচনায় করোনাকালে সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট ছিল না। একইভাবে এনজিওগুলো জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে এগিয়ে এলেও তা যথেষ্ট নয়, কারণ করোনা শিগগিরই চলে যাচ্ছে না।
একটি দেশ যতো উন্নতির দিকে যায় সেদেশের সুশীল সমাজের ভূমিকাও ততো বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করে ড. দীপক বলেন, সেক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব আরো বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তাহলে ‘সাসটেইনেবেলিটি’ও আরো বাড়বে। করোনাকালে কোন এক অদৃশ্য কারণে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সাথে সরকারের অংশীদারিত্ব বা কাজের হার বেশি ছিল। অনেক বিশেষজ্ঞ স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসলেও কাজ করার সুযোগ পান নি।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সুশীল সমাজ আর বাংলাদেশের সুশীল সমাজের ভূমিকা পালনে বিস্তর তফাত রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ড. রাশেদ। তিনি বলেন, করোনাকালে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব ভালোভাবে হয়নি। এনজিওদের সেরকমভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি, সরকারকে পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে। এনজিওদের সরকার সম্পৃক্ত না করলেও তাদের দায়িত্ব ছিল এগিয়ে আসার। করোনা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কমটিতে দেশে অবস্থানরত অনেক স্বনামধন্য মহামারীবিদদের রাখা হয়নি। সরকারও রাখে নি, এনজিওদেরও সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে দেখা যায় নি।
তিনি বলেন, দেশে করোনায় মৃত্যুহার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি দেখালে দুর্নাম হবে কিংবা কম দেখালে সুনাম হবে সরকারের এমন একটা প্রবণতা ছিল। যে কারণে দিনের পর দিন শুধু আইইডিসিআর এ করোনার টেস্ট করা হয়েছে। যার ফল হয়তো দীর্ঘসময় ধরে জাতিকে বয়ে বেড়াতে হবে। আইসিডিডিআরবির মতো আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ল্যাবকে কাজে লাগানো হয়নি। অবশ্য আইসিডিডিআরবির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায়িত্ব ছিল নিজ থেকে এগিয়ে আসার। সমস্যা দুপক্ষেরই ছিল।
তবে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছিল এবং সরকারের সাথে কাজ করার জন্য লেগে থেকেছিল বলে মনে করেন ড. মাহফুজা। তিনি বলেন, প্রাইভেট সেক্টর বা ক্লিনিকগুলোকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রেও বিলম্ব হয়েছে। তবে করোনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। মাস্ক পরা এবং সামজিক দূরত্ব রক্ষায় ‘কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস’ এ কাজ করার অবকাশ রয়েছে।
ড. রাশেদ সহমত পোষণ করে বলেন, এনজিওরা যদি চায় এই ক্ষেত্রে পুরো কাজ তারাই সম্পন্ন করতে পারে।
বর্তমানে দেশে ‘পাবলিক হেলথ এডুকেশন’ এর ধীরে ধীরে বিকাশ হলেও মানের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন ড. দীপক।
সুযোগের অভাবে প্রবাসে থাকলেও দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তার কাজ করার তাগিদ দেশে অবস্থানরত কারো চেয়ে কোন অংশেই কম নয় বলে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন ড. রাশেদ। তিনি বলেন, চাইলে যে কোন জায়গা থেকেই দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ থাকা উচিত।
ড. দীপক আশা ব্যক্ত করেন, এনজিওগুলো শুধু ‘ফান্ড রেইজিং’ এর জন্য দাতাদের দিকে না তাকিয়ে থেকে নিজেরাও কাজ করার মতো সক্ষমতা অর্জনে উদ্যোগী হবে। তিনি বলেন, লিডার কারো জন্য তাকিয়ে বা বসে থাকে না। সে এগিয়ে যায়।